চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

গরুতে স্বাবলম্বী তবুও মাংস আমদানি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১১:২৩ অপরাহ্ণ

আফ্রিকার দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে সেখান থেকে গরুর মাংস আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সরকার এ বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত না নিলেও এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশে মাংস আমদানির প্রয়োজন নেই। বিদেশ থেকে মাংস আনা হলে গ্রামের সাধারণ কৃষকসহ প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদিত গরুর উপযুক্ত দাম থেকে বঞ্চিত হবেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হবে। তাতে দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিখাত চামড়া শিল্পে কাঁচামালের সংকট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত মাসে মার্কোসারভুক্ত চার দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে সফরে যান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়াতে সফরকালে সঙ্গে নেন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকসহ ব্যবসায়ীদেরও। সফর শেষে ফিরে এসে গত ৮ আগস্ট মার্কোসারভুক্ত দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে দেশগুলো থেকে মাংস আমদানির প্রস্তাব দিয়ে একটি ধারণাপত্র সরকারের কাছে পাঠায় সংগঠনটি। তবে সরকার এখনও মাংস আমদানির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তার আগেই মাংস আমদানির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাংস আমদানির সিদ্ধান্ত হলে বেকারত্ব বাড়বে, কাঁচামাল সংকটে পড়বে চামড়া শিল্প।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের জনপ্রতি দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদা হিসেবে বার্ষিক মাংসের চাহিদা ৭২ দশমিক ৯৭ লাখ মেট্রিক টন। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি থেকে মোট মাংস উৎপাদিত হয়েছে ৭৫ দশমিক ১৪ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২ দশমিক ১৭ লাখ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বেঙ্গল মিটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশে গরুর মাংস রপ্তানি করছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, কুয়েত, কানাডা, জাপান ও মালদ্বীপে রপ্তানি প্রায় ৮২ টন মাংস রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।
বিশ্বজুড়ে গরুর মাংসের আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো এ তালিকায় নেই। ২০১৮ সালে রপ্তানি হওয়া ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাংসের ৭২ শতাংশের ক্রেতাই ১৫টি দেশ, যার বেশিরভাগই স্বল্পোন্নত ধনী দেশ। শীর্ষ ১৫ আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, জার্মানি, ভিয়েতনাম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, মিসর, চিলি ও তাইওয়ান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র পাকিস্তান অল্প পরিমাণ গরুর মাংস আমদানি করছে।

এশিয়ার মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ গরুর মাংস আমদানি করে। ওইসব দেশে গরুর চাষাবাদ খুব একটা হয় না বললেই চলে। আর বিশ্বে গরুর মাংস রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আসা কমে যায়। ওই সময় দেশের মাংসের চাহিদা মেটাতে সারা দেশে ছোট ছোট অনেক খামার গড়ে ওঠে। সরকারও গরু মোটাতাজাকরণ ও গাভী পালনে স্বল্পসুদে ঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে গরুর উৎপাদন বেড়েছে। গত দু-তিন বছর ধরে মাংসের বাজারদরও প্রায় স্থিতিশীল রয়েছে। এ অবস্থায় মাংস আমদানি শুরু হলে লোকসানে গরু পালন থেকে খামারিরা সরে যাবেন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ Gসোসিয়েশনের সভাপতি ড. নজরুল ইসলাম বলেন, বিদেশ থেকে অবাধে গরুর মাংস আমদানি হলে আমাদের ডেইরি শিল্প হুমকির মুখে পড়বে, বেকার হবে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষ।

মৌলিক শিল্পে আমদানি নির্ভরতা গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে গ্রামবাংলার কোটি পরিবার ও খামারির জীবন-জীবিকা। হঠাৎ করে মাংস আমদানি করাহলে কর্মহীন হবেন অনেক খামারি। দেশে উদ্বৃত্ত মাংস রয়েছে, তবুও কেন মাংস আমদানি করতে হবে?
প্রাণিসম্পদ গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শরীফ আহমেদ বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে হিমায়িত মাংস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে ওই ধরনের ল্যাব নেই, ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়। মাংস আমদানি হলে দেশের চিরস্থায়ী ক্ষতি হবে। এছাড়া খামার বন্ধ হলে জৈব সারের সংকট দেখা দিবে।

দেশের বাজারে আরও কম দামে মাংস বিক্রি সম্ভব জানিয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম Gসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, এজন্য প্রয়োজন দানাদার জাতীয় খাবারের দাম কমানো।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১০টি সংগঠনের আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে Gনিমেল হেলথ কোম্পানিজ Gসোসিয়েশনের সভাপতি ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি তথ্যমতে, আমরা ইতিমধ্যে প্রাণিজ আমিষে স্বাবলম্বীতা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বিদেশ থেকে হিমায়িত গরুর মাংস আমদানি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। দেশের বৃহত্তর জনগণের স্বার্থে গরুর মাংস আমদানির প্রক্রিয়াটি বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
বক্তারা বলেন গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার প্রায় ১৮ কোটি বর্গফুট চামড়া উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে বাংলাদেশ। চামড়া ও চামড়াজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা আয় করে। এসব শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে প্রায় ৫৬ লাখ লোকের জীবিকা। মাংস আমদানির কারণে গরু পালন কমে গেলে দেশের চামড়া শিল্পেও ধস নামবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন Gনিমেল হেলথ কোম্পানিজ Gসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মমিন উদ্দৌলা, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি Gসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. মো. হাবিবুর রহমান মোল্লা, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম Gসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ এমরান, বাংলাদেশ পোল্ট্রি Gসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার মহসিন, বেঙ্গল মিটের হেড অব কমার্শিয়াল Gন্ড এক্সপোর্ট এ কে এম সাইদুল হক ভূঁইয়া প্রমুখ।

সূত্র : দেশ রূপান্তর

পূর্বকোণ/আফছার

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট