চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সাম্প্রতিক ব্যাংকিং বিশৃঙ্খলা কী বিশ্বকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে

৩০ মার্চ, ২০২৩ | ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

[ক’ সপ্তাহ আগেও বিশ্লেষকরা নিশ্চিত ছিলেন যে বিশ্ব অর্থনীতি তার আপন গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সম্প্রতি সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) আর সিগনেচার ব্যাংক কিংবা ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের পতনের ফলে তারাই এখন আসন্ন গভীর মন্দা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন।]

 

সাম্প্রতিক ব্যাঙ্কিং বিশৃঙ্খলার আগে থেকে আভাস দেয়া হচ্ছিল বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রায় ৩% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধনী দেশগুলোতে সেটার হার ধরা হচ্ছিল ৩.৭%। তবে বেশ ক’টি ব্যাংকের পতনের ফলে এই হার এখন বলা হচ্ছে ৩.৪% মতো হতে পারে। আপাতত আভাসটা এমনি হলেও অনেক বিশ্লেষকই বলতে চাইছেন- এমনিতরো পূর্বাভাস দেয়াটা হয়তো একটু ‘তাড়াতাড়িই’ হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদগণ দুটি উদ্বেগের কথা বলছেন। প্রথমটি হল অনিশ্চয়তা। মানুষ যদি ব্যাংকিং সঙ্কট এবং এর ফলে অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে ভয় পায়, তাহলে তারা খরচ ও বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে।
দ্বিতীয়টি ক্রেডিট সম্পর্কিত। লোকসানের ভয়ে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের ঋণ প্রত্যাহার করতে পারে এবং কোম্পানিগুলিকে প্রয়োজনীয় মূলধন থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
তাদের মতে, সৌভাগ্যবশত, এমন বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে সাম্প্রতিক ব্যাঙ্কিং গোলযোগ ধারণার চেয়ে কম প্রভাব ফেলবে। তারা ২০১৩ সালের আইএমএফ’র একটা সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে চাইছেন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ৩% থেকে কমে সম্ভবত ২.৫% এ নেমে আসবে। আইএমএফ’র সেই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইরাকে মার্কিন আক্রমণ এবং ব্যাঙ্ক ব্যর্থতার মতো কারণগুলির জন্যে বার্ষিক জিডিপি ০.৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। অর্থাৎ ‘অশান্তি অব্যাহত না থাকলে, প্রভাব ততটা তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম’।
পোলস্টার ইপসোসের একটি জরিপে দেখা গেছে যে সিলিকন ভ্যালি-ঘটনার পর তাদের অর্থ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও, ব্যাংকের প্রতি আমেরিকান ভোক্তাদের আস্থা মার্চের প্রথম থেকে মধ্যভাগে বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্চ মাসে জার্মান অর্থনীতির মেজাজও অপ্রত্যাশিতভাবে আরও উন্নত হয়েছিল।
অনেক অর্থনীতিবিদই দ্বিতীয় সমস্যাটি (ক্রেডিট সম্পর্কিত) নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। সংস্থাগুলি যদি অর্থায়নে তাদের হাত প্রসারিত না রাখে তবে অর্থনীতি সহজে বাড়তে পারে না। ২০০৭-২০০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পরের বছরগুলিতে, ধসে পড়া ক্রেডিট মার্কেটগুলি নিকট-মেয়াদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি উভয়ই মন্থর হয়ে পড়েছিল।
এসভিবির পতনের পর পুঁজিবাজার কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। ১১ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত, আমেরিকান কোম্পানিগুলি (জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার ইস্যু করার পরে) নতুন বিনিয়োগ বা বন্ড ইস্যু করেনি। এতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কিন্তু খুব কম লোকই লক্ষ্য করেছে যে বাজার পুনরুদ্ধার হয়েছে। গত কয়েকদিনে, ব্রাউন-ফরম্যান (যেটা অন্যান্য জিনিসের মতো জ্যাক ড্যানিয়েলের হুইস্কিও তৈরি করে) এবং একটি প্রধান উপযোগী প্রতিষ্ঠান ঘরঝড়ঁৎপব, উভয়ই বন্ড মার্কেটে প্রচুর পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করেছে। তবে অতি সম্প্রতি কোম্পানিগুলি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নতুন ঋণ ইস্যু করা থেকে বিরত রয়েছে। তবুও মনে হচ্ছে মার্চ ২০২৩ কর্পোরেট বন্ড ইস্যু করার জন্য একটি সুন্দর গড় মাস হতে চলেছে।
তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্ষতি প্রায় নিশ্চিতভাবেই আরও গুরুতর প্রমাণিত হবে। মার্চের শুরু থেকে বৈশ্বিক ব্যাংকের শেয়ারের দাম এক ষষ্ঠাংশ কমে গেছে। জরিপগুলোও বলছে যে, স্টক মূল্যের পতন নতুন বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিনিয়োগকারীরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহবশত: ব্যাঙ্কগুলিতে তাদের গচ্ছিত আমানত তুলে নিতে থাকলে স্বভাবতই ব্যাঙ্কগুলোও তাদের ঋণপ্রবাহ কমিযে দেবে।
প্রকৃতপক্ষে, ধনী বিশ্বের ব্যাঙ্কগুলি ইতিমধ্যেই তাদের ‘মান’ ধরে রাখতে কঠোর হচ্ছে বলে মনে হয়। গোল্ডম্যান শ্যাক্সের একটি নতুন গবেষণাপত্র অনুসারে, ব্যাঙ্ক ঋণের মন্দা আমেরিকা এবং ইউরো জোন উভয় ক্ষেত্রেই প্রায় ০.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষত্রের অস্থিরতা মার্কিন ব্যাঙ্কগুলিকে বেশি চেপে ধরতে পারে, তবে ইউরোজোনের অর্থনীতি যেহেতু ব্যাংক ঋণের উপর বেশি নির্ভরশীল তাই এটি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২.৫% থেকে কমে প্রায় ২% হবার অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সাম্প্রতিক ব্যাঙ্কিং গোলযোগের পর থেকে এ সেক্টরে ভাল খবর তেমন নেই বটে, তবে বিশ্লেষকগণের মতে, ‘এটি বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনা কম।’ সামনে দিন হয়তো আরো খারাপ আসছে। আরো একাধিক ব্যাংকও হয়তো ‘কোল্যাপস’ হবে, কিন্তু তারা তাদের ওই ‘অভিমত’ প্রত্যাহার করে নিতে নারাজ। তাদের সামনে যে বিশ্বের ২য় অর্থনীতির দেশ চীনের উত্থানের চিত্র স্পষ্ট!
অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন যে, বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বিশ্বের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বছরে ৭% এর বেশি হারে বৃদ্ধি পাবে। সরবরাহ শৃঙ্খলের বাধাগুলি এখন অনেকাংশেই অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং ‘শক্তি’র দামও উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে। তাই ব্যাংকিং খাতের শত অস্থিরতা সত্ত্বেও বিশ্ব অর্থনীতি ‘অস্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতা’ দেখাতে থাকলে অবাক হবার কিছুই থাকবে না।

 

[তথ্যসূত্র : দ্য ইকনোমিস্ট]

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট