চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ঋণ পুনঃতফসিল : আগ্রহ নেই খেলাপিদের

অনলাইন ডেস্ক

২২ আগস্ট, ২০১৯ | ৬:১৪ অপরাহ্ণ

দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন পরিশোধ করার বিনিময়ে ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিল করতে ব্যাংকে আবেদন করছেন ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী। ব্যবসা করতে গিয়ে লোকসানের মুখে ঋণখেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল করার কথা থাকলেও এ সুবিধা পেতে আবেদন করছে অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া আলোচিত প্রতিষ্ঠানগুলোও। অর্থপাচার ও জালিয়াতির মামলায় দণ্ডিত বিসমিল্লাহ গ্রুপের পলাতক মালিকরাও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পেতে আবেদন করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া অ্যাননটেক্সও এ সুবিধা পেতে আলোচনা করছে। বাদ থাকছেন না মুদি দোকানদার, সরিষার তেলের পাইকারি বিক্রেতা ও চাল কল মালিকসহ ছোট ব্যবসায়ীরাও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপিরা ঋণ পুনঃতফসিলে আবেদন করতে পারবেন।

এ প্রতিনিধির হাতে আসা কয়েকটি ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ছোট ব্যবসায়ীরাও ১০ বছর মেয়াদে পরিশোধের সুযোগ নেওয়া ও অনারোপিত সুদের শতভাগ মওকুফের আশায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করছেন। বিভিন্ন সময় ব্যাংক ও সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে তারা খেলাপি হতে বাধ্য হয়েছেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেছেন।

দিনাজপুর সদর উপজেলার বড় বন্দর এলাকার রেল বাজারের দিনাজপুর তেল মিলের মালিক অলোক কুমার কু-ু (শ্যাম) উত্তরা ব্যাংকের দিনাজপুর শাখায় ৪২ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেছেন। সরিষার তেল, সরিষা বীজ ও খৈলের খুচরা এবং পাইকারি বিক্রেতা কু-ু জানান, ২০১১ সালে সিসি হাইপো ২৫ লাখ টাকার ঋণ সুবিধা নেন। দেশে সরিষার পর্যাপ্ত উৎপাদন না হওয়ায় দীর্ঘ কয়েক বছরে মালামাল মজুদ করে ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারেননি। লোকসানের কারণে তার ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে ঋণ হিসাবটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। তিনি খেলাপি হলে ব্যাংক পাওনা ৪২ লাখ টাকা আদায়ে ২০১৪ সালে মামলা করে।

ঋণ পরিশোধের আর্থিক ব্যবস্থা না থাকায় নিজে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ ও আর্থিকভাবে ন্যুব্জ’ উল্লেখ করে পুনঃতফসিল আবেদনে কু-ু লিখেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারির পর ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট বাবদ ৮৪ হাজার টাকা ব্যাংকের শাখায় জমা দিতে গেলে ব্যাংক তা নেয়নি। আমি অনুরোধ করলেও ব্যাংকের ম্যানেজার কোনো উত্তর দেননি। তাতে মনে হয়, ম্যানেজার ইচ্ছাকৃতভাবে ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিতে অস্বীকার করেন।

গত ১৪ আগস্ট নীতিমালার আওতায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ আগামী ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ চেয়ে করা আবেদনে কু-ু নীতিমালা অনুযায়ী অনারোপিত সুদ ১০০ ভাগসহ ইন্টারেস্ট সাসপেন্সে রক্ষিত সুদের শতভাগ মওকুফের অনুরোধ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা উপজেলার ২০/১, বিকে রোডে গম, আটা, ময়দার ব্যবসা করে মেসার্স টাঙ্গাইল ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির দুই অংশীদার মো. আবু সাঈদ প্রিন্স ও মো. আবু সায়েম পিজন ৮৯ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ ২ শতাংশ হারে ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা পরিশোধ করে ১০ বছর মেয়াদে পরিশোধের সুযোগ চেয়ে জনতা ব্যাংকের নিতাইগঞ্জ শাখায় আবেদন করেছেন। আবেদনে তারা বলেছেন, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ১০ লাখ টাকার সিসি হাইপো ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংক। ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৭০ লাখ টাকার ঋণসীমা ভোগ করছিলেন তারা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তারা ৫ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। কিন্তু ব্যাংকের ওই শাখার কর্মকর্তা পরিবর্তনের কারণে ২০১৭ সালের মার্চে বিনা কারণে ঋণটি বন্ধ করে দেয়। তাতে আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হলে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ক্ষতিপূরণ মামলা করি। পরে আমরা ঋণখেলাপি হই। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে দেয়, তা অকার্যকর হয়।

৭০ লাখ টাকার সিসি হাইপো ঋণসীমার ২০১৮ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিক স্থিতি দায় ৮৯ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ ১০ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল ও অনারোপিত সুদ শতভাগ মওকুফ করার কথা বলেছেন টাঙ্গাইল ট্রেডার্সের মালিকদ্বয়।

দিনাজপুর সদর উপজেলার উত্তর গোসাইপুর এলাকার শুভঙ্কর অটো রাইস মিলের মালিক উত্তম কুমার দে গত ১৪ আগস্ট ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেছেন সিটি ব্যাংকের দিনাজপুর শাখায়। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত তার খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ১৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা পুনঃতফসিল চেয়েছেন তিনি। খেলাপি হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমার ব্যবসার ধরন হলো ধান, চাল, গম জাতীয় খাদ্যদ্রব্যের মজুদসহ মিলিং ব্যবসা। এই তিনটি খাদ্যদ্রব্যের মজুদ সংঘটিত করে ব্যবসা চালু রেখে মুনাফা অর্জন সাপেক্ষে ঋণের অর্থ সুদসহ পরিশোধের জন্য ঋণ অনুমোদিত হয়েছিল। খাদ্য বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক মজুদে ব্যাঘাত ঘটায় দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনতে হয়। ঋণের আসল অর্থও বিনষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে আর্থিক দৈন্য ও অসচ্ছলতার কারণে বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠানটি অচল হয়ে আছে। এ কারণে আমি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে খেলাপিতে পরিণত হয়ে আছি। বর্তমানে আমার কোনো ব্যবসা নেই।’

এদিকে জনতা ব্যাংকে আলোচিত ঋণ জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত অ্যাননটেক্স গ্রুপের মালিক ইউনুস বাদল ৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। জনতা ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। এই ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য দুই শতাংশ হারে ৬০ কোটি টাকার ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়ে গ্রুপটির পক্ষ থেকে ব্যাংকে যোগাযোগ করা হয়েছে। বাকি ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকাও স্বাভাবিক নিয়মে পুনঃতফসিল করতে চায় অ্যাননটেক্স। এজন্য তারা ৫ শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট দিতে রাজি আছে।

এছাড়া বিশেষ নীতিমালায় ঋণ পুনঃতফসিল চেয়ে বিসমিল্লাহ গ্রুপের পক্ষ থেকে আবেদন পেয়েছে ব্যাংক। গ্রুপের প্যাডে করা আবেদনে তাদের বর্তমান দায়-দেনার পরিমাণ জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। বর্তমান পাওনার বিপরীতে দুই শতাংশ হারে কত টাকা ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে তাও জানতে চেয়েছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ। গ্রুপের পক্ষে কেউ একজন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে এ আবেদন জমা দিয়েছেন।

অর্থ পাচার ও জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের মামলায় দণ্ডিত বিসমিল্লাহ গ্রুপের মালিক খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী ২০১২ সাল থেকে পলাতক। ভুয়া রপ্তানির কাগজ তৈরি করে জনতাসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত আসামি তিনি।

জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ সালাম আজাদ জানান, অ্যাননটেক্সের মালিক ইউনুস বাদল ঋণ পুনঃতফসিল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শাখার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আর বিসমিল্লাহ গ্রুপের পক্ষ থেকে কেউ একজন এসে একটি আবেদন জমা দিয়ে গেছেন। তবে ব্যাংক এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও সাংবাদিকদের বলেছেন, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পেতে আগ্রহী। তারা ঋণ পরিশোধ করতে চায়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করছে। হলমার্কের কাছ থেকেও ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে বলে আশা করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়া হলে অন্যরা এসব অপরাধে উৎসাহী হবেন। ব্যাংক খাতে খেলাপি কমাতে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি।

 

সূত্র : দেশ রূপান্তর

 

পূর্বকোণ/ রাশেদ

শেয়ার করুন