চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

বিটুমিনের কর কাঠামোয় বৈষম্য, হুমকিতে দেশীয় উৎপাদন শিল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ জুন, ২০২১ | ২:৫২ অপরাহ্ণ

সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের অন্যতম উপকরণ বিটুমিনের কর কাঠামোতে নজিরবিহীন কর-বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তকে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা আইনের পরিপন্থী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা। এটিকে ‘এক দেশে দুই আইন’ আখ্যা দিয়ে তারা বলছেন, এই দ্বৈত আইন ও নীতি দেশীয় শিল্পকে টুঁটি চেপে ধরার শামিল।

জানা গেছে, বিপুল বিনিয়োগে গড়ে ওঠা দেশীয় বিটুমিন শিল্পে উৎপাদন পর্যায়ে অযৌক্তিকভাবে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কর বিদ্যমান থাকলেও, আমদানিতে অনেক কম। বিটুমিন উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে অন্যায্যভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বিদ্যমান। অথচ পরিশোধিত বিটুমিন আমদানিতে ভ্যাট নেই। আমদানির বিটুমিন সরবরাহ পর্যায়ে যেখানে ভ্যাট মাত্র ৫ শতাংশ, সেখানে দেশীয় উৎপাদকের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটের খড়গ রয়েছে। বিটুমিন উৎপাদনে প্রতি টনের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ ৫৭০ মার্কিন ডলার হলেও, আমদানিতে তা ২৬০ ডলার। এই বৈষম্যমূলক কর কাঠামো বাতিল করে দেশীয় শিল্প সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য ও রাজস্বনীতি বিশ্লেষক মনজুর আহমেদ বলেন, দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় মৌলিক কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ককর কমাতে হবে। বিটুমিন উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল পেট্রোলিয়াম অয়েলস এন্ড অয়েলস অবটেইন্ড মিনারেলস, ক্রুড আমদানিতে শুল্ককর বা সিডি ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা উচিত। আর ১৫ শতাংশ ভ্যাট যেহেতু আমদানিতে নেই, তাই উৎপাদনেও রাখা যাবে না। এর সঙ্গে আগাম কর বা এটি ৩ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর বা এআইটি ২ শতাংশ বাতিল করতে হবে। কারণ এই ধরনের কর কাঠামোর মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর নিয়মনীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রীতিনীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, অগ্রিম আয়কর বা এআইটি দিয়ে ব্যবসার পরিচালন খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট বা এটিভি আগে ছিল বাণিজ্যিক আমদানিতে। এখন কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর বা এটি আরোপ করা হয়েছে, এটা প্রত্যাহার করা উচিত।

তার মতে, যেখানে তৈরি পণ্য আমদানিতে ভ্যাট নেই, সেখানে উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ অযৌক্তিক ও অন্যায়। দেশীয় বিটুমিন সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাটও অপ্রত্যাশিত।

তথ্যমতে, দেশে এখন বিপুল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথম শর্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। সড়ক ব্যবস্থা প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। টেকসই সড়ক নির্মাণের মূল উপাদান হলো- ভালো মানের বিটুমিন। দেশে বিটুমিনের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন। যা অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছরই বাড়ছে।

জানা গেছে, বিটুমিনের ব্যবহার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সড়ক নির্মাণ, বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণসহ ফুটপাথ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। এ ছাড়াও নহর তৈরিতে বা ট্যাংকের ভিতর প্রলেপ হিসাবে, নদী বা সমুদ্রের কিনারে তটরক্ষক হিসেবে ও নৌকার তলদেশে প্রলেপরূপে বিটুমিনের ব্যবহার হয়। ভারী শিল্পেও এর ব্যবহার হয়। এটি বিদ্যুৎরোধকের কাজেও যুক্ত করা হয়। ইন্সুলেটিং টেপ, পানিরোধী কাপড় ইত্যাদি কাজেও বিটুমিন ব্যবহার হয়। বার্নিশ, অয়েল পেইন্ট, রাবার এনামেলের বিকল্প ও কোল্ড স্টোরেজ, ইলেকট্রোনিক ব্যাটারি, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, বিটুমিন আমদানির চেয়ে উৎপাদনে বাড়তি কর আরোপ, দেশীয় শিল্পের স্বার্থবিরোধী। সরকারের শিল্প সুরক্ষা নীতিরও পরিপন্থী। দেশীয় শিল্পের সঙ্গে এই বৈষম্যমূলক কর কাঠামো যথাযথ কর্তৃপক্ষের সংশোধন করা উচিত।

কাস্টমস সূত্র বলছে, অসাধু আমদানিকারকরা আন্ডার ইনভয়েসিং বা দাম কম দেখিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বিটুমিন ভর্তি ড্রাম খালাস করেন। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে শুল্কফাঁকি। বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। রাস্তা নির্মাণে ব্যবহৃত বিটুমিন আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা থামছে না। ভেজাল বিটুমিন আসছেই, নীরব কাস্টমস। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা হচ্ছে বিটুমিন, রাজস্ব ফাঁকি ধরাছোঁয়ার বাইরে। কার্যত বিটুমিন আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ। বিএসটিআই, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বুয়েটের অনুমোদন ছাড়াই বিটুমিন আসছে দেশে। চট্টগ্রাম বন্দরের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সেগুলো ছাড়পত্রও পেয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-সিসিসিআই সভাপতি ও বিটুমিন আমদানিকারক মাহবুবুল আলম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারদর দেখে কাস্টমসকে বিটুমিনের শুল্কায়ন করতে হবে। আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধে কাস্টমসের নজরদারি রাখতে হবে। দেশে যেহেতু উন্নত মানের বিটুমিন উৎপাদন হচ্ছে, তাই আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট