চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সংকটেও থামছে না চাল পাচার

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

২২ এপ্রিল, ২০২১ | ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

খাদ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরকারি খাদ্য গুদামের খাদ্য সহায়তা ও ত্রাণের চাল পাচার কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও খাদ্য-পরিবহন ঠিকাদার, ডিও ব্যবসায়ী ও চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে পাচার হয়ে আসছে সরকারি চাল। এছাড়া চাল ব্যবসা ছাড়াও খাদ্য অধিদপ্তরের পরিবহন ঠিকাদারও তারা। এতে তারা সোনায় সোহাগা। তাই প্রতিবছরই চাল পাচারের বড় বড় চালান ধরা পড়লেও অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে রাঘব-বোয়ালরা।

সংশ্লিষ্টদের অভিমত, খাদ্য অধিদপ্তর ও গুদাম কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরা না গেলে সরকারি চাল পাচার রোধ করা সম্ভব নয়। দেশে চাল সংকটের মধ্যেও প্রতাপের মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছে সরকারি চাল।

গতকাল বুধবার পাহাড়তলী চাল বাজারে অভিযান চালিয়ে ৭০ হাজার কেজি সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। চাল পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্য চাল ব্যবসায়ী বাহার মিয়াকে (৪৪) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভারত থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানিকৃত চাল বন্দর জেটি থেকে খালাস হয়ে নোয়াখালীর চরভাটা এলএসডি গোডাউনে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই চাল চলে গেল পাহাড়তলী চাল বাজারে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এবার দুর্ধর্ষ পাচার বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নঈম মো. শফিউল আলম গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘মিডিয়া ও পুলিশের কাছ থেকে বিষয়টি শুনেছি। এরপর আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি।’ দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাল পাচার হয়ে আসলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত বছরের ফারুক ট্রেডার্সের চাল আদালতের নির্দেশনায় দরিদ্রের মধ্যে বিক্রি করা হয়েছে। আগের ঘটনা আমার জানা নেই।’  সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত বাহার মিয়া সরকারি চাল পাচারকারী সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা পাহাড়তলী বাজারের চাল ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দিনের ছোট ভাই। শাহাব উদ্দিনের গুদাম থেকে ইতিপূর্বে সরকারি চাল আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। শাহাব উদ্দিন ছাড়াও চাল পাচারের ওই ঘটনায় হালিশহর খাদ্য গুদামের গুদাম নিয়ন্ত্রক প্রণয়ন চাকমা ও সহকারী ম্যানেজার ফখরুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়েছিল। প্রণয়ন চাকমা বর্তমানে অবসরে গেছেন। আর ফখরুল বান্দরবানের রুমায় কর্মরত আছেন। তবে ফখরুল রুমার চেয়ে বেশি সময় দেন নগরীর সদরঘাট বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে। খাদ্য বিভাগের বদলি-বাণিজ্য ও ক্যাশিয়ার হিসাবে পরিচিত ফখরুল।

গতকালের ৭০ হাজার বস্তা চাল পাচার ছাড়াও গেল বছরের এপ্রিলে পাহাড়তলী বাজার থেকে ২১ বস্তা সরকারি চাল আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাহাড়তলী বাজারের চাল ব্যবসায়ী মেসার্স ফারুক ট্রেডার্সের গুদাম থেকে উদ্ধার করেছিল সরকারি ত্রাণের চাল। এছাড়াও ১৫শ’ খালি বস্তা ও ৯ হাজার চটের বস্তা উদ্ধার করা হয়েছিল। সরকারি চালের বস্তা পাল্টিয়ে নুরজাহান ব্র্যান্ডের বস্তায় ভরে বাজারজাত করার সময় তা জব্দ করেছিল পুলিশ।

একাধিক সূত্র জানায়, পাহাড়তলী ও চাক্তাইয়ের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাল পাচার করে আসছে। পাহাড়তলী বাজারে খাজা ভান্ডারের শাহাবউদ্দিন ও তার সহযোগী তনজিলা এন্টারপ্রাইজের এম আলম (পটিয়ার আলম) সরকারি চাল পাচারের অন্যতম হোতা।

২০১৭ সালে হালিশহর সিএসডি খাদ্য গুদাম থেকে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ সরকারি চালসহ দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। এই ঘটনায় খাদ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা, পাহাড়তলী ও খাতুনগঞ্জের দুই ব্যবসায়ী, ট্রাকচালকসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলার পাহাড়তলী চাল বাজারের খাজা ভান্ডারের শাহাব উদ্দিন এবং খাদ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম ও প্রণয়ন চাকমাকে আসামি করা হয়েছিল। এ ঘটনার একদিন আগে আকবর শাহ থানা পুলিশও বিপুল পরিমাণ সরকারি চাল জব্দ করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাল পাচার হয়ে আসলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য অধিদপ্তর।

অভিযোগ রয়েছে, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা, হালিশহর-দেওয়ানহাট সিএসডি খাদ্য গুদাম নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক-খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডিও ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী ও চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যোগসাজশে পাচার হয়ে আসছে সরকারি চাল। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় খাদ্য গুদাম দুটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগের অন্ত নেই। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি খাদ্যবান্ধব ও ত্রাণের চাল বস্তা পাল্টিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়। লাভ বেশি হওয়ায় এই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে পাচার করে আসলেও তা সহজে রোধ করা যাচ্ছে না।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাহাড়তলী ও চাক্তাই পাইকারি বাজারে সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) ২৯শ থেকে তিন হাজার টাকা। সেই হিসাবে কেজি হচ্ছে ৫৮-৬০ টাজা। কিন্তু সরকারি চালের ডিও কেনা হয় কেজি প্রতি ৪০-৪২ টাকা দরে। চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কেজিতে লাভ হয় প্রায় ২০ টাকা। বড় অঙ্কের লাভের কারণে সরকারকে ঠকিয়ে লাভবান হচ্ছেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ পাচারকারি সিন্ডিকেট।

চাল সংকট : অভ্যন্তরীণ চাল সংকট ও মজুদ কমে আসায় সরকার চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যেই ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করছে সরকার। গত বছর থেকে অভ্যন্তরীণ চাল উৎপাদন কমে আসা ও করোনাভাইরাস আতঙ্কের পর চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। সংকটের কারণে সরকারের খাদ্যবান্ধব বিভিন্ন প্রকল্প অনেকটা সীমিত করা হয়েছে। অনেক প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছে। তারপরও ভারত থেকে আমদানি করা ৭০ হাজার কেজি চাল পাচার হয়ে যােেচ্ছ।

ডিও ব্যবসার আড়ালে চাল পাচার : দীর্ঘদিন ধরে ‘ডিও’ বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হয়ে আসছে খাদ্য বিভাগের সরকারি চাল। মূলত চাক্তাই ও পাহাড়তলী চাল বাজারকেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে এই চাল পাচার কাজে জড়িত। পাহাড়তলী বাজারের শাহাব উদ্দিন, মো. আলম, ফারুক ছাড়াও শাহাবউদ্দিনের ব্যবসায়ী অংশীদার এয়াকুব ট্রেডার্সের এয়াকুব মুন্সি এই চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট হচ্ছে সরকারি চাল পাচারের বড় হোতা। তাদের গুদাম থেকে বার বার চাল ধরা পড়ার পরও অদৃশ্য কারণে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে এসব সিন্ডিকেট।

পাচার নেপথ্যে : ডিও ব্যবসার আড়ালে চাল পাচারে আছেন মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ডিও কিনে চাল ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন এই চক্রটি। এই চক্রেরও রয়েছে খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদারি ব্যবসা। এরমধ্যে ধীরেন্দ্র নাথের (ধনা বাবু) মেয়ের জামাই জনি, আবদুর রহিম ও মোরশেদ। এই তিনজন ডিও কেনাবেচা ও পরিবহন এবং খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেন এই সিন্ডিকেট। মধ্যস্বত্বভোগী এই সিন্ডিকেট বার বার অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট