চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

বিমুখ হচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা

ইফতেখারুল ইসলাম 

৪ মার্চ, ২০২১ | ১২:১৫ অপরাহ্ণ

খাতুনগঞ্জ বিমুখ হচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা। যাদের কারণে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে একসময় দেশি-বিদেশি বড় ক্রেতা-বিক্রেতা সমাগম ছিল, সেসব শিল্পগ্রুপ ক্রমেই তাদের অফিস গুটিয়ে নিচ্ছে। শুধু অফিস নয়, অনেক ব্যবসাও এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, আনুমানিক ৮০০ শতাব্দী হতেই ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রাম পরিচিতি লাভ করে। আর চট্টগ্রামের ব্যবসার প্রাণ হল চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। দেশের অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান যারা খাতুনগঞ্জ থেকে প্রথম ব্যবসা করে পুঁজির বিকাশ ঘটিয়ে দেশের কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা এখন খাতুনগঞ্জে নেই। তার অন্যতম প্রধান কারণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়া এবং মালামালের ঝুঁকি।

একসময় এখানে যে ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা ছিল নানা কারণে তা আজ আর নেই। পাকিস্তান আমলে যে সরু সড়ক ছিল এখনো তাই আছে। বরং কিছু এলাকায় সড়ক সংকুচিত হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থারও কোন পরিবর্তন হয়নি। এখানে আনুষাঙ্গিক নাগরিক সুবিধা গড়ে উঠেনি। আগ্রাবাদ কিংবা অন্যান্য এলাকায় যেভাবে বাণিজ্যিক পরিবেশের উন্নয়ন হয়েছে, খাতুনগঞ্জে তুলনামূলকভাবে সে হারে হয়নি। একারণে ব্যবসায়ীরা খাতুনগঞ্জ বিমুখ হয়ে গেছে।

এসব চালের বাজারের বড় একটি অংশ চাক্তাই থেকে পাহাড়তলীর দিকে সরে গেছে। একইভাবে সরে গেছে লোহা সিমেন্টের ব্যবসাও। কিছু গেছে পাহাড়তলীতে। কিছু গেছে ঢাকা ট্রাংক রোডে। আর কিছু অক্সিজেন রোডে চলে গেছে। আবার কিছু ব্যবসায় চট্টগ্রামের বাইরে চলে গেছে। অনেক বড় বড় শিল্প গ্রপের অফিস এখন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে নেই। থাকলেও সেখানে তেমন কার্যক্রম নেই। পিএইচপি ফ্যামেলি, হাশেম কর্পোরেশন, কেডিএস গ্রুপ, টি কে গ্রুপ, এস এ গ্রুপসহ অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ তাদের অফিস খাতুনগঞ্জ থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এস আলমও আগ্রাবাদে কর্পোরেট বিল্ডিং নির্মাণ করছে। বড় বড় গ্রুপ অব কোম্পানিজসমূহ সরে যাচ্ছে। কারণ এসব স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে দেশি-বিদেশি ক্রেতা এবং বিক্রেতা আসে। এসব যানজট, বিশৃঙ্খলা মাড়িয়ে চলাচল করতে তাদের কেউ স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান এখনো তাদের অফিস খাতুনগঞ্জ থেকে সরায়নি, তারাও খাতুনগঞ্জের বাইরে কোথাও না কোথাও অফিস করেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, এই ব্যবসা কেন্দ্রের যানজটের আরো একটি উপাদান হল সড়কে অযাচিতভাবে ছোট গাড়ি ও ভ্যান রাখা ইত্যাদি এবং কোথাও কয়েকফুট জায়গা পেলে সেখানে দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া। হাজার কোটি টাকার মালিকের অফিসেও পার্কিং ব্যবস্থা নেই। অপরদিকে, অল্প বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা হয়। এমনকি জোয়ারের পানিতে মালামাল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারণ এখানে খুব দ্রুত পানি উঠে। আরেক বড় ধরনের ঝুঁকি হল অগ্নিকাণ্ড। এখানে কোথাও অগ্নিকান্ড ঘটলে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি সহজে প্রবেশ করতে পারে না। যেখানে রাস্তার একপাশ থেকে অপরপাশ হেঁটে যাওয়া কঠিন সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কিভাবে যাবে এমন প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন সিনিয়র সহ-সভাপতি আবুল বশর পূর্বকোণকে বলেন, এখানে অর্ধশতাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই। খাতুনগঞ্জ থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তার তুলনায় এখানে সুবিধা বাড়েনি। অবকাঠামোগত সুবিধা না বাড়লে ব্যবসায়ীরা স্বাচ্ছন্দে ব্যবসা করতে পারেন না। তাই যে যার মত করে অফিস সরিয়ে নিচ্ছে।

চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম পূর্বকোণকে বলেন, পরিবহন সমস্যা, পণ্যের ঝুঁকিসহ নানা কারণে এই বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে ব্যবসা অন্যত্র সরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসা কেন্দ্রের ঐতিহ্য রক্ষা করা যাবে না।

চট্টগ্রাম ডাল মিল ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুর রশিদ আমু বলেন, একদিকে জলাবদ্ধতা, যানজটসহ নানা সমস্যা, অপরদিকে ওজন স্কেল। এসব সমস্যার কারণে ব্যবসা চট্টগ্রামের বাইরে চলে যাচ্ছে।

প্রফেসর শায়েস্তা খান তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, এক সময় চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যিক হাব ছিল। সরকারের অতি কেন্দ্রীকরণ নীতি, ঢাকায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বেশি পাওয়া, সফল বাণিজ্যিক ব্যাংকের সদরদপ্তর ঢাকায় হওয়াতে ব্যাংকের নেক নজর প্রাপ্তির সুযোগ, রাজধানী হওয়াতে মন্ত্রী আমলাদের আনুকুল্য পাওয়ার সুযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত সকল দপ্তর রাষ্ট্রীয় ক্রয় বা ব্যবসা-বাণিজ্যপ্রাপ্তি সহজলভ্যতা, সরকারি আনুকুল্যে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি। এসব উপাদানের অনুপস্থিতিতে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম। ৮০ দশকের পর থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক বড় বড় গ্রুপ অব কোম্পানিজ গড়ে উঠেছে। অথচ এর আগে চট্টগ্রামে ছিল দেশের সবচেয়ে বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। তাদের পেছনে কোন ক্ষমতা বা রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। তারা সত্যিকারের ব্যবসা করতেন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট