চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

হয়রানিতে কাহিল ব্যবসায়ীরা

ইফতেখারুল ইসলাম 

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:০৮ অপরাহ্ণ

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জকে দেশের ওয়ালস্ট্রিট বলা হয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাণিজ্যের এই প্রাণকেন্দ্র এখনো দেশের ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য পণ্যের মূল আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতা। এখানকার ব্যবসায়ীক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর এখনো সারা দেশের বাজার দর অনেকটাই নির্ভর করে। কিন্তু এখানকার ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করতে ৩২টি সরকারি সংস্থা এবং দপ্তরের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেবা নিতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশিরভাগেরই ক্ষমতা নেই চট্টগ্রাম থেকে সিদ্ধান্ত দেয়ার। কোন জটিলতা সৃষ্টি হলে ব্যবসায়ীদের ঢাকায় ছুটতে হয়। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা আছে তাদের দক্ষ জনবল নেই, লোকবল সংকট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামে অবস্থিত সরকারি দপ্তরসমূহের ক্ষমতায়ন, কর্মপরিধি বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামে অবস্থিত সরকারি আঞ্চলিক দপ্তরসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও এসব সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। তবে এই সমস্যাগুলো চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকার ব্যবসায়ীদেরও।

ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বে-টার্মিনাল নির্মাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, আগামীর কন্টেইনার চাহিদা মোকাবেলায় পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ দ্রুত সম্পন্ন করা এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ খুবই জরুরি। আরো জরুরি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনে বন্দরে পর্যাপ্ত জেটি, ইয়ার্ড ও ওয়্যারহাউস নির্মাণ করা জরুরি। কর্ণফুলী ড্রেজিং ত্বরান্বিত করা এবং বন্দর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ নদীর উভয় তীরে নতুন করে কোন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়া যাবে না। তৈরি করতে হবে কানেক্টিভিটি। যা চট্টগ্রামে অপ্রতুল। বন্দরকে আন্তর্জাতিক বন্দরে রূপান্তরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস হ্রাসকরণের অংশ হিসেবে সকল স্টেকহোল্ডারদের জন্য একটি সমন্বিত ও যুগোপযোগী নীতিমালা এবং সার্ভিস চার্জ প্রণয়ন করা প্রয়োজন। গ্লোবাল পোর্ট, গ্লোবাল সিটি’র বাস্তবিক রূপান্তরে বেসরকারি আইসিডি/অফডকগুলোকে আগামী এক বছরের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের ২০ কিলোমিটারের বাইরে স্থানান্তরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে সমন্বয়সাধনপূর্বক ব্যবস্থা নিতে হবে।

আইসিডি নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ অফডকসমূহে আইএসপিএস কোড ব্যবহার এবং আইসিডির সামনে অপেক্ষমাণ ট্রাক/লরির কারণে সৃষ্ট যানজট নিরসনে পার্কিং রোধ করাসহ জরিমানা করা যেতে পারে। আমদানি-রপ্তানির জটিলতা কমিয়ে অটোমেশন করা প্রয়োজন। ট্রাক/লরিগুলোর পাস কার্ড টার্মিনাল থেকে ইস্যু করা হলে গেইটে যানজট হ্রাস পাবে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েকে ৮ লেনে উন্নীত করা ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ। আমদানি-রপ্তানির প্রতিটি ধাপে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেসের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানির পর বিপদজনক বিবেচনা কার্গো ফেরত পাঠানোর কারণে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকগণ মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এ বিষয়ে স্পষ্ট সরকারি সিদ্ধান্ত থাকা প্রয়োজন। সদরঘাট-মাঝিরঘাট ও বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে ভোগ্যপণ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাতে দ্রব্যমূল্য এবং চাহিদা ও যোগান স্থিতিশীল থাকে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে আইসিডি স্থাপন করা হয়েছে। তবে অনেক আইসিডির সেবার মান এবং অতিরিক্ত চার্জ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ডেলিভারি গতিশীল করতে আরো বেশি স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করতে হবে এবং এসব মেশিন পরিচালনার জন্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দিতে হবে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসে জনবলকাঠামো অনুযায়ী জনবল নেই। কাস্টমসের লোকবল বৃদ্ধি এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃক সিটিএমএস’র সাথে কাস্টমস’র এসাইকুডা প্লাসের সুসমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।

আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর, ঢাকা থেকে ইস্যুকৃত ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বরের পত্রের পর থেকে ‘মন্ত্রণালয় বা পোষক কর্তৃপক্ষের সুপারিশ ব্যতীত আমদানি ও রপ্তানি অধিদপ্তরের কোন আঞ্চলিক দপ্তর হতে কোন প্রকার আমদানি পারমিট ইস্যু করা যাবে না। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে সকল প্রকার আমদানি পারমিট (আইপি) ইস্যু করা হবে’ মর্মে নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই নির্দেশনা বাতিল করে এই সেবা চট্টগ্রাম থেকেই পেতে চান ব্যবসায়ীরা।

প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বাণিজ্য সহায়ক প্রতিষ্ঠান যেমন: আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ইত্যাদির আঞ্চলিক কার্যালয়কে যথাযথ ক্ষমতায়ন ও পর্যায়ক্রমে প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসে লোকবল বৃদ্ধি ও বিমানবন্দরে হেল্প ডেস্ক নিশ্চিত করা। চট্টগ্রামের বিসিক শিল্পাঞ্চলে অনেকগুলো প্লট পরিত্যক্ত অবস্থা আছে। আবার কিছু সংখ্যক প্লটে কারখানা তৈরি হলেও উৎপাদন নেই। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে অধিক সংখ্যক পরিদর্শক নিয়োগ ও কার্যক্রমে গতি বৃদ্ধি প্রয়োজনীয়তার কথাও ব্যবসায়ীরা বলেছেন। দেশীয় উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রমের সাথে সংগতি রেখে বিএসটিআই, চট্টগ্রামের সক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি, আধুনিক সুযোগসম্বলিত পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। তাতে অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেশন প্রদান সম্ভব হবে এবং ভেজাল পণ্য উৎপাদন রোধ করা যাবে।

আমদানিকারকদের সুবিধার্থে আইপি ইস্যু কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ অটোমেশন করা হয়েছে। তাই অটোমেশন ব্যবস্থার সুফল নিশ্চিত করতে একে পুরোদমে চালু করা এবং ব্যবহারকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যাপক পরিসরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।

সিডিএ চাকতাই-খাতুনগঞ্জসহ আশপাশের বাণিজ্যক এলাকাকে একটি বাণিজ্যেক জোন হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া আপাতত সমস্যা নিরসনে চাক্তাই সংলগ্ন সরকারি জমিতে টার্মিনাল নির্মাণ এবং চাক্তাই খাতুনগঞ্জের সড়কসমূহ প্রশস্তকরণের উদ্যোগ নিতে পারে। একইকাজটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও করতে পারে। চট্টগ্রামকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মাস ট্রান্সপোর্ট, হাউজিংসহ ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক ছাড়া দেশের অন্যকোন মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণের স্কেল নেই। তাই বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশে শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় লাঘব করে পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালে রাখার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে দুই এক্সেলবিশিষ্ট মোটরযানে ১৩ টন ওজন পরিবহনের বাধ্যবাধকতা স্থায়ীভাবে বাতিল করার বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এখানে কোন ব্যাংকের হেড অফিস না থাকার কারণে সাধারণ চেক বই ইস্যু করা থেকে শুরু করে ঋণ অনুমোদনসহ সব ধরনের অনুমতির জন্য ঢাকার উপর নির্ভর করতে হয়। যা সময় ও অর্থ অপচয় ঘটায়। তাই কমপক্ষে ৫টি ব্যাংকের হেডঅফিস চট্টগ্রামে হওয়া উচিত।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক সব সুযোগ সুবিধা রয়েছে। এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে কর্মরত আছেন। একইসাথে ব্যবসায়িক প্রয়োজনেও অনেক বিদেশি চট্টগ্রাম ভ্রমণ করেন। তাই ঢাকা থেকে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইট চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে পরিচালনা করা হলে বিমান কোম্পানিগুলো লাভবান হবে এবং মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে পারবে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগির আহমদ বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের সংগঠনের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এসব সমস্যার কথা তুলে ধরেছি। তাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুফলও মিলেছে। আমাদের দাবিসমূহে শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ নেই। এখানে মূলত সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত। কারণ কোন ধরনের জটিলতার কারণে কোন পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই আদায় করা হয়। এছাড়া  ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি হয়। এজন্য উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। এতে সময়ক্ষেপনের কারণে কোন কোন ভোগ্যপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। সরকারকে এসব বিষয় ভেবে দেখার অনুরোধ জানান তিনি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট