চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম কাস্টমস: পণ্য ধ্বংসের নিজস্ব জায়গা নেই

সারোয়ার আহমদ 

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

পণ্য আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফি বছর নিলাম অযোগ্য পণ্য ধ্বংসের পরিমাণ বাড়লেও এগুলো ধ্বংস করার মতো নিজস্ব কোন জায়গা নেই দেশের সিংহভাগ রাজস্ব যোগানদাতা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের। তাই পণ্য ধ্বংসের কাজে প্রায়ই অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনায় পড়তে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যখনই নিলাম অযোগ্য পণ্য ধ্বংসের প্রয়োজন পড়ে তখনই চট্টগ্রাম কাস্টমসকে খুঁজতে হয় পণ্য ধ্বংসের জন্য সুবিধাজনক জায়গা। আবার পণ্য ধ্বংসের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে গিয়ে গেলে সেখানেও পড়তে হয় বাড়তি ঝামেলার। কাস্টমসের প্রস্তাবিত জায়গা পর্যবেক্ষণ করার পর সে সংক্রান্তে ছাড়পত্র দিতে লেগে যায় দীর্ঘসময়। এতে পণ্য ধ্বংস কার্যক্রমে দেখা দেয় দীর্ঘসূত্রিতা।

নিয়মানুযায়ী কোন পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩০ দিনের মধ্যে খালাস না করলে আমদানিকারককে ১৫ দিনের নোটিশ দিয়ে ওই পণ্য নিলামে তোলে কাস্টম হাউস। এছাড়াও মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যসহ আইনি বিভিন্ন জটিলতায় আমদানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে যায়। নিলামে তোলার মতো অবস্থায় না থাকলে কিংবা নিলামেও পণ্য বিক্রি না হলে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাওয়া পণ্য ধ্বংস করতে উদ্যোগ নিতে হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে। আর সেই উদ্যোগ নিতে গিয়েই শুরু হয়  বিড়ম্বনা পর্ব।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তারা এমনই দুর্গতির সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মাস খানেক আগে ৩২৬ কনটেইনার পণ্য ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছে। নিজেদের পণ্য ধ্বংস করার জায়গা না থাকায় নিয়মানুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে আলোচনা করে পণ্য ধ্বংসের জায়গা নির্বাচনের কাজ শুরু করেছে। পরিদর্শন শেষে আলোচ্য পণ্যের ধ্বংস কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে কবে সম্পন্ন করা যাবে, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।

এর আগে সদ্যগত বছরের ২ ডিসেম্বর ৪৯টন বিপজ্জনক কেমিকেল ধ্বংস করতে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে ট্রাকে করে ওই পণ্য সুনামগঞ্জ পাঠাতে হয়েছে। নিজস্ব জায়গা না থাকায় প্রতিবারেই কাস্টমসকে পণ্য ধ্বংস করতে জায়গা খুঁজতে হয়। নিজস্ব জায়গা থাকলে পণ্য ধ্বংস কার্যক্রম নিয়মিত ও দ্রুত করা যেত। বাড়তি ঝামেলা আর পোহাতে হত না, জানান কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট কর্তারা।

জানা যায়, ৩২৬ কনটেইনারে থাকা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টন পণ্য ধ্বংস করতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশসহ মোট দশ সরকারি সংস্থার সাথে আলোচনা করেছে। চলমান এই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের সুবিধাজনক জায়গা বাছাইর কাজ চলছে। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তরের চাচ্ছে হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং স্টেশনে পণ্য ধ্বংস করতে। কিন্তু সেখানে ধ্বংসের জন্য ডাম্পিং ব্যয়ের বাড়তি চাপ নিতে হবে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে। আবার সেখানে ধ্বংসযোগ্য পণ্য নিয়ে যাওয়ার মতো অবকাঠামোও নেই। যে কারণে নিজস্ব জায়গার কথা জোর দিয়ে ভাবছে চট্টগ্রাম কাস্টমস।

পণ্য ধ্বংসের কাজে রয়েছে কাস্টমসের তিক্ত অভিজ্ঞতা : পণ্য ধ্বংস করতে গিয়ে বিপাকে পড়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমসের। পণ্য ধ্বংসের নিজস্ব জায়গা না থাকায় গত ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর পতেঙ্গা এলাকার বিজয়নগরে দুই দিনব্যাপী পণ্য ধ্বংসের কার্যক্রম শুরু করেছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। ৪ ডিসেম্বর প্রথম দিনে ১৭ কনটেইনার পচা পণ্য ফেলা হয় ওই জায়গায়। পরদিন ৫ ডিসেম্বর আরো ১৩ কনটেইনার পচা পণ্য ফেলার জন্য নিলে এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা। এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার প্রতিবাদে সেদিন সকালে বিমানবন্দর সড়কের পাশে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। তাঁদের বাধার মুখে প্রায় দুই ঘণ্টা পণ্য ধ্বংস করার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পরে এলাকাবাসীর সঙ্গে বৈঠকের পর আবার কার্যক্রম শুরু করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।

সে সময় ধ্বংসের তালিকায় থাকা পণ্যের মধ্যে পচা মাছ থাকায় দুর্গন্ধ বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল। পচা মাছবাহী কনটেইনার বন্দর থেকে বিজয়নগর এলাকায় নেওয়ার সময় কনটেইনার থেকে সড়কে পচা মাছের পানি পড়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তবে বেশি দুর্গন্ধ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য বড় গর্ত খুঁড়ে প্রথমে পচে যাওয়া মাছ ফেলা হয়। এর ওপর নষ্ট হয়ে যাওয়া ফল, আদা ও রসুন ফেলা হয়। এরপরও দুর্গন্ধ থাকায় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছিল।

যা বললেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ডাম্পিং স্টেশনে কাস্টমসের বর্জ্য ধংসের ব্যপারে জানতে চাইলে চসিক উপ প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদ আলম পূর্বকোণ বলেন, আমরা গড়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম সিটির প্রায় আড়াই হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করে ধ্বংস করি। কাস্টমসের যে বর্জ্য ধ্বংসের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে তা চসিক’র ডাম্পিং স্টেশনে করা সম্ভব। তবে নিয়মানুযায়ী প্রতি টন বর্জ্যরে জন্য কাস্টমসকে ভ্যাটসহ ৫৭৫ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া কাস্টমসের তত্ত্বাবধান ও খরচেই ওই বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে আসতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক (মেট্রো) মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী পূর্বকোণকে বলেন, কাস্টমসের পণ্য ধ্বংস করতে আমাদের সাথে আলোচনা হয়েছে। সুবিধামত জায়গা দিতে না পারায় সে কাজ এখনো আটকে আছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা সদর দপ্তর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে আমরা চাই কাস্টমস সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং স্টেশনে এ কাজ করুক। কিংবা সেই জায়গায় না হলেও সিটি কর্পোরেশনকে সঙ্গে নিয়েই কাস্টমস পণ্য ধ্বংসের কাজটি করুক।

পণ্য ধ্বংসে নিজেদের জায়গা না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম পূর্বকোণকে বলেন, আমাদের পণ্য ধ্বংস করার জন্য নিজস্ব কোন জায়গা নেই। এজন্য বন্দর উপদেষ্টা কমিটির গত সভায় আমি বন্দরের কোন সুবিধামত জায়গা কাস্টমসের পণ্য ধ্বংসের কাজে ব্যবহারের জন্য দিতে প্রস্তাব করি। জায়গা পেলে আমাদের পণ্য ধ্বংসের কাজ সহজ হবে। ব্যয় কমবে কাজের গতিও বাড়বে। এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা হয়েছে উল্লেখ করে কাস্টমস কমিশনার বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছেও আমরা জায়গার জন্য আবেদন করবো। তাদের কোন প্রজেক্টে আমাদের পণ্য ধ্বংস করা যায় কিনা এমন জায়গার ব্যবস্থা করতে আবেদন করবো।

প্রসঙ্গতঃ বন্দরের ভেতরে কনটেইনারে থাকা পণ্য ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে বর্জ্যে পরিণত হলে সেই কনটেইনার ভর্তি বর্জ্য সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানো কাস্টমসের জন্য দূরূহ একটি ব্যাপার। কারণ সিটি কর্পোরেশনের দুই ডাম্পিং স্টেশনে কনটেইনার ভর্তি ট্রেলার বা প্রাইম মুভার নিয়ে যাতায়াত করার মত পর্যাপ্ত জায়গা  নেই। মুভমেন্ট করতে গিয়ে কনটেইনারসহ ট্রেলার উল্টে গিয়ে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। যেটি কাজের জটিলতা আরো বাড়াবে। আর এসব বর্জ্য ধ্বংস করতে গিয়ে কাস্টমসে খরচ করতে হবে বিপুল টাকা।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট