চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সুফল মিলছে না কৃষি বিপ্লবের

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম ও পার্বত্যাঞ্চলে সবজি আর ফলফলাদি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। গত ১০ বছরে জেলায় সবজি উৎপাদন বেড়েছে ৪২ শতাংশ। আর পার্বত্যাঞ্চলে ফল উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুনের কাছাকাছি। কৃষকের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি। কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও মৌসুম ছাড়া মিলে না সবজি-ফলফলাদি। এক মৌসুমের সবজি ও ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরেক মৌসুম পর্যন্ত।

উৎপাদন সূচক ঊর্ধ্বমুখী হলেও দামের বেলায় আকাশ-পাতাল ফারাক দেখা যায়। মৌসুম শুরুতে যে সবজি শ, দেড় বা দু’শ টাকায় বিক্রি হয়, তা আবার নেমে যায় ১০-২০ টাকায়। দাম না পাওয়ার কারণে ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই পচে। কখনো রাগে-ক্ষোভে ফেলে দেয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক ও ভোক্তা। হিমাগার বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান তারা। এনিয়ে আশা-নিরাশার দোলা দেশীয় বাজারে নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রেও বিপর্যস্ত অবস্থা। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় সবজি ও ফলফলাদির ভালো চাহিদা থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সরকারের নজরদারির অভাবে মার খাচ্ছে রপ্তানিখাতও।

উৎপাদন সূচকের সঙ্গে বাজার বণ্টন, দামের ভারসাম্য ও রপ্তানি নীতিমালা বজায় রাখতে আধুনিকমানের হিমাগার নির্মাণের দাবি কৃষক, ভোক্তা ও রপ্তানিকারকদের। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে যে হারে ফলের উৎপাদন বাড়ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয়ের একটা বড় অংশ আসবে ফলের বাণিজ্যিকীকরণ মাধ্যমে।

কৃষক বাজারের সাধারণ সম্পাদক ও নিজামপুর এগ্রোর মালিক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামে সবজি ও ফলফলাদির কোনো হিমাগার না থাকায় সংরক্ষণ এবং রপ্তানি খাতে ক্ষতি হচ্ছে। পার্বত্য জেলা থেকে সরবরাহ করে আনা ফলমূল বিক্রি করতে না পারলে মান নষ্ট হয়ে যায়। কম দামে বিক্রি বা পচে নষ্ট হয়ে যায়। তখন লোকসান গুনতে হয়। অনেক সময় পুঁজি হারাতে হয়। সংরক্ষণ করা গেলে বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে’।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালে ষোলশহর এলাকায় হিমাগার নির্মাণ করেছিল বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। কিন্তু আঁতুরঘরেই মৃত্যু ঘটে সেই হিমাগারের। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকার অপচয় ছাড়া সুফল মিলেনি।

বিএডিসির যুগ্ম পরিচালক (পটিয়া উদ্যান) ড. জাহাঙ্গীর আলম পূর্বকোণকে বলেন, ‘নির্মাণের পর হিমাগারটি বন্ধ হয়ে যায়। তা আর চালু করতে পারিনি। তবে কৃষির উন্নয়নে সরকার নতুন নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। ষোলশহরে নির্মিত হিমাগারটি আধুনিকমানে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই ঢাকা থেকে একটি প্রকৌশলী দল তা পরিদর্শন করে গেছেন’।

সবজিভা-ার খ্যাত চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী এলাকার সবজি চাষী আজম খান ও এম এ ফয়েজ বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে টমেটো ১২০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। এখন বিক্রি করতে হচ্ছে পানির দরে। ১০-১৫ টাকায়। টমেটো ছাড়াও অন্যান্য সবজি বিক্রিতেও একই দশা হয়। অনেক সময় মজুরি খরচ পোষাতে না পেরে ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যায়। বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিতে হয় নদীতে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে অন্তত পুঁজি রক্ষা করা যাবে’।

কৃষি বিভাগ জানায়, জেলার চন্দনাইশ, সীতাকু-, বাঁশখালী, মিরসরাই, আনোয়ারা, রাঙ্গুনীয়া এবং নগরীর পতেঙ্গা, হালিশহর এলাকায় ব্যাপকভাবে সবজি চাষ হয়। গত ১০ বছরে সবজি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ২০১০-২০১১ মৌসুমে উৎপাদন ছিল পৌনে তিন লাখ মে. টন। বর্তমানে (২০২০-২০২১ সাল) উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৮২৪ টন। শীতকালীন সবজি ছাড়াও রবিশস্যের উৎপাদনও বেড়ে চলেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান পূর্বকোণকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রণোদনা ও প্রদর্শনী খামারের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘কৃষক বাজার’র বাজার ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করা হচ্ছে’।

মাঠ পর্যায়ের কৃষকেরা জানান, মৌসুম শুরুতে ভালো দাম পাওয়া যায়। কিন্তু ভরমৌসুমে উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়ে যায়। তখন সবজির দাম অস্বাভাবিক কমে যায়। ১০-১৫ গুন কম দামে বিক্রি করতে হয়। অনেক সময় কাক্সিক্ষত দর না পেয়ে ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই পচে যায়। এতে নিরুৎসাহিত হয় কৃষক। অথচ কৃষকের শ্রমে-ঘামে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি।

তবে আশার বাণী শোনাচ্ছে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। চট্টগ্রামের সবজি ভা-ার খ্যাত দোহাজারী ও সীতাকু-ে দুটি হিমাগার নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে অধিদপ্তর।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জেলা বাজার কর্মকর্তা মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘দোহাজারী ও সীতাকু-ে সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণ উপযোগী দুটি হিমাগার নির্মাণ করবে সরকার। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে’।

মৌসুমভিত্তিক রপ্তানি : বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে সবজি রপ্তানি হয়। মধ্যপাচ্য ও ইউরোপে বেশি রপ্তানি করা হয়। পানি কচু থেকে কচুলতি, ফুল, মুখী, ওলকচু, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, আলু, বেগুন, তিতকরলা, কাঁকরল, পটোল, ঝিঙে, শসা, বরবটি, শিম, লেবু, জলপাই, সাতকরা, বাঁশের কোড়ল, কলার মোচা, শালগমসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি রপ্তানি করা হয়। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বেশির ভাগ সবজি মৌসুমভিত্তিক রপ্তানি করা হয়। আর কিছু সবজি সারাবছর রপ্তানি করা হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে বাংলাদেশের মৌসুমি ফল ও সবজির কদর বেশি। তবে বিদেশিরাও কিছু কিছু ফল-সবজি খেতে অভ্যস্ত।

কৃষি বিভাগের উদ্ভিদ সংঘনিরোগ জানায়, করোনার কারণে আকাশপথে সবজি রপ্তানি বন্ধ ছিল। তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ৭০৪ টন সবজি রপ্তানি হয়েছে। এছাড়াও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০৪৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২০৯৬ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১১৫ টন সবজি রপ্তানি হয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়ি কাঁঠাল বেশি রপ্তানি হয়। এছাড়াও লেবু, কালো জাম, জলপাই, চালতা, আখও রপ্তানি করা হয়।

চট্টগ্রামে আধুনিকমানের হিমাগার নির্মাণের দাবি জানান রপ্তানিকারকদের সংগঠন চট্টগ্রাম ফ্রেশ ফ্রটস ভেজিটেবল এন্ড প্রোডাক্টস রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি মাহবুব রানা। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘সরকার ষোলশহর এলাকায় হিমাগার নির্মাণ করলেও তা একদিনের জন্যও চালু করা হয়নি। হিমাগার না থাকায় মৌসুম ছাড়া ফলমূল ও সবজি বিদেশে রপ্তানি করা যাচ্ছে না’।

পার্বত্য অঞ্চলে বিপ্লব :

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় সবজি ছাড়াও ফলমূলের বিপ্লব ঘটেছে। আনারস, কাঁঠাল, কলার ব্যাপক চাষ হয়। এছাড়াও কমলা, মাল্টা, কাজু বাদামের মতো দামি ফলের চাষ হচ্ছে। আম উৎপাদনে তো নীরব বিপ্লব ঘটেছে।

রাঙামাটি :

পার্বত্য জেলার রাঙমাটিতে ২০১০-২০১১ সালে আম উৎপাদন হয়েছে ২২ হাজার ৩২৩ টন। কাঁঠাল ৬৮ হাজার ৫৪৩ টন, লিচু ৫ হাজার ৬১৫ টন, কলা  এক লাখ ১৮ হাজার ৬১৫ টন, তরমুজ ৭১৩৯ টন ও আনারস ৪৮৯৪৩.৩ টন। ২০১৯-২০২০ সালে আম উৎপাদন হয়েছে ৩৯ হাজার ৮৫৭ টন। কাঁঠাল ৯৬ হাজার ৭৪৪ টন, লিচু ১৭৪৯৮ টন, কলা দুই লাখ ৪৩ হাজার ২৭৬ টন, তরমুজ ১০ হাজার ৮৭৮ টন ও আনারস ৫৫ হাজার ৮৫০ টন।

রাঙামাটি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিসেস ইতি চাকমা পূর্বকোণকে বলেন, রাঙামাটিতে কোন হিমাগার না থাকায় প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার ফল নষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও পাহাড়ে উৎপাদিত কলা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। কলা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে যায়। ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন চাষীরা।

বান্দরবান :

বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৪৪ ধরনের ফলফলাদি উৎপাদনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা যায়, ৪৪ হাজার ২৪১ হেক্টর জমিতে ফলের আবাদ করা হয়। এতে ৮ লাখ ১৭ হাজার ১৯২ টন ফল উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে আম উৎপাদন ছিল ৮১ হাজার ৯৪০ টন। কাঁঠাল উৎপাদন ৭৫ হাজার। লিচু উৎপাদন ৬ হাজার ৬০ টন। আনারস উৎপাদন ৯০ হাজার ৮২০ টন। কমলা ২৯ হাজার ৫০ টন। কাজু বাদাম এক হাজার ৫০ টন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট