চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

তিন পণ্যে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

ইফতেখারুল ইসলাম  

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:১১ অপরাহ্ণ

নগরীর শুলকবহর এলাকার বাসিন্দা নার্গিস বেগম তিনটি বাসায় মাসে আড়াই হাজার টাকা করে বুয়ার (গৃহকর্মী) কাজ করেন। মোট সাড়ে ৭ হাজার টাকা আয় থেকে বাজার খরচ চালান। ভ্যানচালক স্বামী বাসা ভাড়া দেন। চাল, তেল এবং জ্বালানি- এই তিনটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজার পরিবারের বাজার খরচ চালাতে তিনি এখন হিমশিম খাচ্ছেন। আরো একটি কাজ খুঁজছেন তিনি। শুধু নার্গিস নয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠি থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মাসের বাজার খরচে টান পড়েছে। এদিকে করোনা মহামারীর কারণে আয় কমে গেছে, অপরদিকে প্রধান নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সীমিত আয়ের লোকজনের সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্যমতে এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ এবং খোলা ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। দুই মাসের ব্যবধানে এলপি গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে সিলিন্ডার প্রতি ২০০ টাকা।

চালের বাজার

টিসিবি’র তথ্যমতে, ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি খুচরা বাজারে সরু চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৪ থেকে ৬০ টাকা। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি তা বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ৫.২৬ শতাংশ। ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মাঝারি চাল বিক্রি হয়েছিল ৪৪ থেকে ৫০ টাকায়। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকায়। বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১৭.০২ শতাংশ। একই সময়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৩২ থেকে ৩৬ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৫.২৯ শতাংশ।

খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ১ জুলাই সরকারের হাতে খাদ্য মজুদ ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ লাখটন। ২০২০ সালের জুলাইয়ে খাদ্য মজুদ ছিল ১১ দশমিক ৮৮ লাখ টন। তবে বর্তমানে (২৫ জানুয়ারি ২০২১ সাল) পর্যন্ত সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে ৭ দশমিক ৪ লাখ টন। এর মধ্যে চালরয়েছে ৫ লাখ ৪৮ হাজার টন এবং গমের মজুদ এক লাখ ৫৬ হাজার টন। আমদানির পাশাপাশি সরকার ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রমও জোরদার রেখেছে। চলতি আমন সংগ্রহ (২০২০ সালের ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া) চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি সর্বমোট ৫১ হাজার ২৬ টন ধান-চাল সংগ্রহ হয়েছে। তবে আমন মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন। জানুয়ারির শুরুর দিকে দুই দফায় ১৭৭ টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৭৬ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত এক মাসে সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ টন। এর মধ্যে বেসরকারিভাবে গত ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি হিলি স্থল বন্দর দিয়ে চার দফায় দুই হাজার ১৫৩ টন চাল আমদানি হয়।

চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওমর আজম পূর্বকোণকে বলেন, গত বছর বন্যার কারণে ধান উৎপাদন কম হয়েছে। তাছাড়া মোটা চালের উপর শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানির জন্য যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেখানেও নানা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। শর্তের বেড়াজালে অনেকেই অনুমোদন নিয়েও চাল আমদানি করতে পারেনি। চাল আমদানির অনুমতি উন্মুক্ত করে দিলে দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসত উল্লেখ করে বলেন, যে যার সামর্থ অনুযায়ী আমদানি করলে প্রতিযোগিতার কারণে দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকতো। তিনি জানান, মোটা চাল অর্থাৎ বেতি চালও ৫০ টাকার নিচে মিলছে না।

ভোজ্যতেলের বাজার

টিসিবি’র তথ্যমতে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ থেকে ১১৮ টাকায়। গত বছরের এই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৮৮ থেকে ৯২ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে এই তেলের দাম বেড়েছে ২৮.৮৯ শতাংশ। বোতলজাত সয়াবিন তেল (৫ লিটার) গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছি ৪৭০ থেকে ৫২০ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৫৭০ থেকে ৬২৯ টাকায়। দাম বেড়েছে ২০.২০ শতাংশ। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছিল ১০৫ থেকে ১১৫ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। দাম বেড়েছে ২০.৪৫ শতাংশ। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি খোলা পাম তেল বিক্রি হয়েছিল লিটার ৭০ থেকে ৮২ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৯৭ থেকে ১০০ টাকায়। দাম বেড়েছে ২৯.৬১ শতাংশ। গত বছরের একই তারিখে সুপার পাম অয়েল বিক্রি হয়েছিল ৮২ থেকে ৮৬ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ১০২ থেকে ১০৫ টাকায়। দাম বেড়েছে ২৩.২১ শতাংশ।

তবে গতকাল খুচরা বাজারে ভোজ্য তেল বিক্রি হয়েছে টিসিবি’র দেয়া মূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি। খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে লিটার ১২৮ টাকায়। প্যাকেটজাত ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের একাধিক তেল ব্যবসায়ী জানান, ২০২০ সালের জুলাই মাসে সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ৩২০০ টাকায়। গত ২০ দিন আগে তা সাড়ে চার হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকে। গত সপ্তাহে তা চার হাজার টাকা নেমে এলও গতকাল আবারো বেড়ে ৪৪৪০ টাকায় উঠে যায়। গত জুলাইয়ে পাম অয়েলের মণ ছিল ২২৫০ টাকা। ২০ দিন আগে তা ৩৯০০ টাকায় উঠে যায়। গত সপ্তাহে তা ৩৩০০ টাকায় নেমে আসে। এই সপ্তাহে তা ফের বেড়ে ৩৫৫০ টাকা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস’র তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টাম বন্দর দিয়ে ১৮ লাখ ২১ হাজার মেট্রিকটন (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত)  ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। এরআগে ২০১৯ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিকটন। তবে সরকারিভাবে দেশে ভোগ্যপণ্যের প্রকৃত চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি ও নিট সরবরাহের চিত্র না থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি ভূমিকাও কাজে আসছেনা বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

ভোজ্যতেলের পাইকারি ব্যবসায়ী আলমগীর পারভেজ জানান, গত জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন ভোজ্যতেল বিক্রি হয়েছিল ৫২৫ থেকে ৫৩০ ডলারে। এখন তা হাজার ডলারের কাছাকাছি দামে বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে গেছে।

ট্রেডিং ব্যবসায়ী আমান উল্লাহ জানান, কারসাজি করছে মিল মালিকরা। আন্তর্জাতিক দাম বাড়লেও আমাদের দেশে তার ধাক্কা লাগতে অন্তত তিন মাস লাগার কথা। কারণ এলসি খুলে তেল আমদানি করতে প্রায় তিন মাস লেগে যায়। কিন্ত আমদানিকারক এবং মিল মালিকরা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সাথে সাথে এখানে বাড়িয়ে দেয়।

এলপি গ্যাস সিলিন্ডার

গত ডিসেম্বর মাসেও ১২ কেজি এলপি গ্যাস বিক্রি হয়েছিল ৮৫০ টাকায়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতি সিলিন্ডারে ২০০ টাকা বেড়ে ১০৫০ টাকা হয়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজি (সিলিন্ডার) গ্যাস এর আন্তর্জাতিক দর ছিল প্রতি টন ২৩৭ টাকা। গত জানুয়ারি মাসে তা বিক্রি হয়েছে ৫৩৬ ডলারে। এপ্রিল থেকে জানুয়ারি প্রতিমাসেই এই গ্যাসের দাম বেড়েছে। ওমেরা গ্যাসের ডিজিএম মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান পূর্বকোণকে বলেন, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে উঠানামা করে। বিশেষ করে শীতকালে দাম বেড়ে যায়। আবার গরমকালে দাম নামতে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এই গ্যাসের দাম এখন সর্বোচ্চ দাম চলছে। তবে তারা সিলিন্ডারের দাম বাড়ায়নি। তবুও খুচরা পর্যায়ে অনেক সময় দাম কিছুটা বেড়ে যায়।

ক্যাবের বক্তব্য

ক্যাব কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভোজ্যতেল ও চালের বাজার বেশ কয়েকমাস ধরেই অস্থির। তার সাথে যুক্ত হয়েছে এলপি গ্যাস। করোনার এই মহামারী সংকটে ‘মরার ওপর খারার ঘা’ হিসাবে দেখা দিয়েছে প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠির ওপর। ভোজ্যতেলের বাজার গুটিকয়েক বড় ব্যবসায়ীদের দখলে আর চালের বাজার পুরোটাই মিলমালিকদের কাছে জিম্মি। সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে মিলমালিকদের। তারা চাল এনে তাদের গুদামে মজুত করছেন। আর সরকার এখানে পুরোপুরি নীবর দর্শক। ক্যাব থেকে সংকটকালীন সময়ে খাদ্য বিভাগের আওতায় ওএমএস চালু করা, টিসিবির মাধ্যমে চাল ও ভোজ্যতেল বিক্রির দাবি করা হলেও সংকটকালিন সময়ে টিসিবি নিস্ক্রিয় এবং তাদের পণ্যতালিকায় আর চাল ও ভোজ্যতেল নাই। আছে পঁচা পেয়াঁজ। একারনে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যতদিন না প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে উদ্দেশ্য করে সরকারী  বিধিবিধান ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে না, ততদিন সমস্যার উত্তরণ ঘটবে না। আর এ কারনে দেশে ধনী-গরীবের বৈষম্য, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মাঝে বৈষম্য বাড়ছে। যার চুড়ান্ত পরিনতি হবে অস্থিরতা, সহিংসতা ও সুশাসনের অভাব। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা দিয়ে বাজার তদারকি সম্ভব নয়। লোকবল ও লজিস্টিক সুবিধা বাড়াতে হবে। ভোক্তারা সচেতন হলেই ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম সংকট ও কুটকৌশল বুঝতে পারবে। ক্যাব থেকে নিত্যপণ্যের বাজার তদারকি জোরদার, বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্য রোধ করে ভোক্তা প্রতিনিধি অর্ন্তভুক্ত করা, তদারকিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন, ভোক্তা ও গণমাধ্যম প্রতিনিধি সমন্বয়ে সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার, জেলা ও উপজেল প্রশাসনের কার্যসুচিতে নিত্যপণ্যের বাজার তদারকিকে অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসাবে যুক্ত করা গেলে কিছুটা সুফল মিলবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট