চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফিরে দেখা ২০২০: আশা-নিরাশার দোলায় অর্থনীতি

শিবু কান্তি দাশ, ঢাকা অফিস

২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ | ২:৪৩ অপরাহ্ণ

২০২০ সাল দেশের অর্থনীতিতে বেশ বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে গেল। বিশেষ করে বছরের শুরুতে মহামারী করোনা ব্যবসা বাণিজ্যকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসেছে। ব্যবসার পুঁজি হারিয়েছে সিংহভাগ ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে অনেকেই বেকার হয়েছেন। তারা পাচ্ছে না কোন সরকারি সহায়তা। ফলে আবার যে ঘুরে দাঁড়াবে তার কোন ভরসা তারা পাচ্ছেন না। এর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে সাংঘাতিকভাবে। এ ধাক্কা সামলাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে কিন্তু তা খুব বেশি আশার সঞ্চার করে না।

জানা গেছে, করোনায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পোষাতে সরকারের কাছে দ্বিতীয় দফায় আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের আবেদন, করোনায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ৫০ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। পণ্যের চাহিদাও কমেছে। শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে গেছে। ভেঙে পড়েছে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ব্যবসায়ীদের সহজে ঋণ প্রদান জরুরি হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, সারাদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও কল-কারখানাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে শিল্প খাত। শুধু কি বাংলাদেশ? বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে সারা বিশ্বও। করোনার কারণে দেশে দেশে এই সংকট তীব্র হচ্ছে। ধনী-গরিব সব দেশেই এর প্রভাব পড়েছে। বেশির ভাগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকোচন হবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে। কর্মহীন হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। এমন দুর্গতির মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশার কথাই শুনিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এমন অবস্থায় সব দাতাসংস্থাই বলছে, এত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। এছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কতটা গভীর হয়, এর ওপর নির্ভর করছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কতটা ত্বরান্বিত হবে। তাই ওই সব সংস্থা চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে।

আইএমএফ বলছে, চলতি ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ গায়ানা ও দক্ষিণ সুদানের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। তবে আইএমএফ এও বলছে, করোনার আগের মতো ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বাংলাদেশকে আরও চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। এডিবি বলছে, বাংলাদেশ ৩০ দেশের মধ্যে ২৬তম। বাংলাদেশের পেছনে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান। এই তালিকায় শীর্ষে আছে তাইপে। এরপরই সিঙ্গাপুরের অবস্থান। তাহলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা কতটা ভালো আছেন ? এডিবি বলছে, বাংলাদেশ ১০০ এর মধ্যে ৪৩ পয়েন্ট পেয়েছে। এর মানে ভালো থাকার মাঝামাঝি অবস্থানেও নেই বাংলাদেশ।

চলতি অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গরিব লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দারিদ্র্য হার সাড়ে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে। যাঁরা দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় করতে পারেন না, তাঁদের দরিদ্র হিসেবে ধরে বিশ্বব্যাংক।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, করোনায় দারিদ্র্য হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত জুন মাসে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় এসেছে, দারিদ্র্য হার দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

সরকারি তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা।

এত দ্রুত বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ করোনার প্রথম তিন-চার মাস যত বেকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখনো কাজ পাননি। চাকরির বাজার এখনো আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি।

গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে সেই তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত এপ্রিল-জুন সময়ে ৩২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার পোশাক উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯ সালের একই সময়ে ৬৯ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার পোশাক বানানো হয়েছিল। করোনা এভাবেই আমাদের শিল্প খাতে ক্ষত চিহ্ন রেখেছে।

এত কিছুর পরও আমাদের অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন গত জুলাই থেকে নভেম্বর ৫ মাসে ১১ বিলিয়ন ডলার যোগ হয়েছে আমাদের রিজার্ভে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বছরের টার্গেটের ৬০ শতাংশ ৫ মাসে চলে এসেছে। এই ফ্লো অব্যাহত রাখতে পারলে রিজার্ভ ফান্ড বেড়ে যাবে। পাশাপাশি যে সমস্ত মেগাপ্রকল্প আছে সেগুলোর পেমেন্টও করতে হয়’। তিনি বলেন, ‘জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ১০০ মিলিয়ন ডলারের মতো পেমেন্ট করেছি, সেটাও ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ থেকে যাচ্ছে। সবকিছু যাওয়ার পরও ৪২ বিলিয়ন ডলার নেট হাতে আছে’।

আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমরা যদি বিশ্বাস করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে পারি এবং সেগুলো ডলারে রিসিভ করতে পারি তাহলে ফান্ড ফ্লো ইনটেক থাকল এবং আমাদের ইনকামটাও অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।

এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়া এবং আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যেও বেড়েছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ১৫ হাজার ৬৪২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি। গত (২০১৯-২০) অর্থবছরের একই সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। বেড়েছে  ইন্টারনেটভিত্তিক বা অনলাইন ব্যাংকিং। এপ্রিল থেকে অক্টোবর এই সাত মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা লেনদেন বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, লকডাউনে ব্যবসায়ীদের অবস্থা খারাপ গেলেও এখন বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী সাহসী প্রণোদনা প্যাকেজ এবং দিকনির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই এখন টিকে থাকার লড়াই করছেন। এই সময়ে ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও হয়রানি মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিরুদ্ধে নতুন বছরে সরকারের একশন দেখতে চান এই ব্যবসায়ী নেতা।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট