চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

সেই মোহ এখনো কাটেনি

ওমর কায়সার

৩ জুন, ২০১৯ | ২:৩০ পূর্বাহ্ণ

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম পর্বটি আমাদের উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠ্য ছিল। স্কুল পর্যায়ে এর আগে শ্রীকান্তের ছোট্ট একটি অংশ আমাদের নবম শ্রেণির পাঠ্য ছিল। সে কারণে এই উপন্যাসটির প্রতি আগ্রহ ছিল। তবে এই আগ্রহ আমাদের দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল মমতাজউদ্দিন

স্যারের কারণে। তিনি ছিলেন নাটকের মানুষ। একটি উপন্যাসকে কীভাবে নাটকীয় ভঙ্গিমায় ছাত্রদের সামনে উপস্থিত করতে হয় তা তিনি জানতেন। তাঁর ক্লাসের জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। এই উপন্যাসে অনেক চরিত্র। ইন্দ্র, পিয়ারী বা রাজলক্ষ্মী, অভয়া, গহর, কুমার সাহেব, টগর, বঙ্কু, কমললতা, ব্রজানন্দ, পুঁটিসহ আরও অনেকে। প্রতিটি চরিত্রের কথাগুলো স্যার নিজে অভিনয় করে বলতেন। তখন আমাদের সামনে চরিত্রগুলো মূর্ত হয়ে উঠত। মনে হতো যেন উপন্যাসের ঘটনাগুলো আমাদের সামনে ঘটছে। অবাক বিস্ময়ে আমরা স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আশ্চর্যের বিষয় তিনি বই দেখে ডায়লগগুলো বলতেন না। বইয়ের প্রতিটি পাতা যেন তাঁর মুখস্থ ছিল। রাজলক্ষ্মীর কান্নার দৃশ্য এলে তিনি যেন নিজেই কেঁদে উঠতেন। আর বলতেন এই পর্যন্ত রাজলক্ষ্মী ৩০ বার কাঁদল। পড়াশোনার প্রতি আমাদের আগ্রহ তেমন ছিল না। কিন্তু, মমতাজ উদ্দিন স্যার, রণজিৎ চক্রবর্তী, সামশুল আলম সাঈদ স্যারের ক্লাস আমরা কখনো মিস করতাম না।
আমরা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েছি ১৯৭৬ -৭৭ সালে। চার দশক আগে চট্টগ্রাম কলেজের গ্যালারিতে বাংলা নাটকের সেই উজ্জ্বল মানুষটির ক্লাসের কথা এখনো ভুলতে পারছি না। এখনো যেন জীবন্ত তিনি আমার চোখের সামনে। ৪০ মিনিটের ক্লাসে তিনি কখনো চেয়ারে বসতেন না। কখনো চিৎকার করে, কখনো লাফিয়ে, কখনো বোর্ডে লিখে তিনি আমাদের মোহগ্রস্থ রাখতেন। আমরা নিজের অজান্তে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই মোহ এ জীবনে কাটলো না। আমাদের সেই মোহের মধ্যে রেখেই তিনি আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
আমাদের প্রতি মমতাজ উদ্দীন স্যারের বিশেষ ভালোবাসা ছিল। কারণ আমরা স্কুল বয়স থেকে লেখালেখি করতাম। সৃজনশীল ছাত্রদের তিনি একটু আলাদা চোখে দেখতেন। আর তিনি চাইতেন আমরা যেন নাটকের সঙ্গে যুক্ত হই। চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের স্যারের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৯৭৩ সাল থেকে চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনে তরুণদের প্রণোদনা দিতেন তিনি। উদ্বুদ্ধ করতেন। নিজের নাটক পরিচালনা, অভিনয় এবং সর্বোপরি নাটকের সাংগঠনিক কাজকর্ম করতেন। বলতে গেলে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম সারির মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মতো মানুষের ছাত্র হতে পেরে আমি নিজে গর্বিত। স্যার নেই, কিন্তু তাঁর হাজারো ভক্ত পৃথিবীতে আছে। আরও অনেক দিন থাকবে। আর থাকবে তার সৃষ্টি। তার রচনা। বাংলা নাটকের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি আরও বহুদিন আমাদের মাঝে আলো ছড়াবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট