চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

ফ্রি ভিসার অপর নাম মরণ ফাঁদ

ধরপাকড়ে সংকুচিত হচ্ছে সৌদি আরবের বড় শ্রমবাজার

কামাল পারভেজ অভি হ সৌদিআরব

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪৯ পূর্বাহ্ণ

মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদিআরবে ধরপাকড়ের কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে সৌদি আরবের বড় শ্রমবাজার। প্রতিদিন ধরপাকড়ের শিকার হয়ে দেশে ফিরছে বাংলাদেশিরা। আবার অনেকে ফ্রি ভিসায় এসে ও কপিলের কোন কাজ না থাকায় তাদেরকেও পুনরায় দেশে ফিরতে হচ্ছে। সৌদিআরবে ফ্রি ভিসায় আসা কিশোরগঞ্জের শোয়েব হোসেন দশ বছর আগে তথাকথিত ‘ফ্রি’ ভিসায় সৌদি আরবে গিয়ে দোকান দিয়ে ভালোই চালাচ্ছিলেন। কিন্তু তার সাজানো জীবন বদলে যায় অক্টোবরের মাঝামাঝি রিয়াদে পুলিশের অভিযানে আটক হওয়ার পর।
পুলিশ তাকে নিয়ে যায় ডিপোর্টেশন ক্যাম্পে। কয়েক দিন পর তাকে শূন্য হাতে ফেরত পাঠানো হয় বাংলাদেশে। দেশে ফেরা শোয়েব হোসেনের সঙ্গে যখন কথা হয়, তার কণ্ঠে কেবলই হতাশা।
তিনি বলেন, ‘আরেক দোকানের সামনে থেকে আমাকে ধরে নিয়ে গেল। আমার দোকানের সামনেও যেতে পারি নাই। প্রায় ৪০ লাখ টাকার মালামাল ছিল দোকানে, কিছুইতো আনতে পারি নাই। কেবল ফোনটা ফেরত দিয়েছে।’
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাবে জানা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে চলতি বছরের প্রথম দশ মাসেই ২০ হাজার ৬৯২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আর সৌদি আরবের জেদ্দা বাংলাদেশ কনস্যুলেটের শ্রম উইংয়ের হিসাবে গত ১১ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১০৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশি ইতিমধ্যে দেশে ফিরে গেছেন।
অভিবাসন নিয়ে গবেষণা ও প্রবাসী কল্যাণে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, মন্দার কারণে সৌদি আরবে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের নাগরিক বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে তেলসমৃদ্ধ দেশটির সরকার। এর অংশ হিসেবে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মভঙ্গের অভিযোগে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে তারা।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসানের মতে, সৌদি আরব থেকে শ্রমিকদের ফিরে আসার সবচেয়ে বড় কারণ তথাকথিত ফ্রি ভিসার নামে সেখানে গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়া। পাশাপাশি অনেক পেশায় সৌদিকরণের কারণে প্রবাসী শ্রমিকরা সেখানে থাকার সুযোগ হারাচ্ছেন।
শরিফুল আরো বলেন, যে ৬-৭ লাখ টাকা খরচ করে শ্রমিকরা বিদেশে যায়, সেখানে কাজ করে সেই টাকা উঠানো অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এ কারণে অনেকে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে ফেলে। কিন্তু নির্দিষ্ট কফিল বা নিয়োগকর্তার বাইরে কাজ করার সুযোগ সৌদি আরবের আইনে নাই।
ফ্রি ভিসা মানে মরণ। নির্দিষ্ট কাজে না গিয়ে ‘ফ্রি ভিসায়’ গিয়ে যেকোন কাজ করতে পারার একটি পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে। সৌদি আরবের আইনে ‘ফ্রি ভিসা’ বলতে কিছু নেই। তবে আত্মীয়-স্বজন কিংবা রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে অনেক শ্রমিক সেখানে যায়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবে যান ভোলার ফুয়াদ হোসেন। তিনি ছয় লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে গত সপ্তাহে রিক্ত হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে।
প্রথমে গিয়ে টাকার বিনিময়ে ইকামার ব্যবস্থা হলেও মেয়াদশেষে খরচ আর ওঠেনি। অবৈধ অবস্থায় কাজ করার পর ধরা পড়ে আটদিন আটক থাকতে হয় ফুয়াদকে।
২০১৭ সালের শেষের দিকে সৌদি আরবের নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষে ১২টি খাতে কেবল সৌদি নাগরিকদের নিয়োগের ঘোষণা দেয় দেশটির সরকার। তারমধ্যে গাড়ি ও মোটর সাইকেল শোরুম, তৈরি পোশাক ও পুরুষ আর শিশুদের পোশাক, গৃহস্থালি পণ্যের শোরুম, গৃহস্থালি তৈজসপত্রের শোরুম, গাড়ির যন্ত্রাংশ, ঘড়ির দোকান, চশমার দোকান, চিকিৎসা পণ্যের দোকান, আবাসন উপকরণের দোকান, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎচালিত সামগ্রীর দোকান, কার্পেটের দোকান এবং কনফেকশনারি দোকান রয়েছে।
এদিকে ‘ফ্রি ভিসার ব্যাপারে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ্ বলেন, দেখা যায় সৌদি আরবের কোন ছোট কোম্পানি, তাদের সক্ষমতা নেই লোক নিয়োগের, কিন্তু সে কয়েকজন লোকের চাকরির অনুমোদন নেয়। তখন তার নামে শ্রমিকদের জন্য ভিসা ইস্যু হয়। এরপর ওইব্যক্তির কাছ থেকে ইকামা নিয়ে শ্রমিকরা অন্য জায়গায় কাজ করে।
সৌদিআরবে যেতে আগ্রহীদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ফ্রি ভিসা বলতে আসলে কিছু নেই। এখানে কাজ করতে হলে ইকামা থাকতে হবে এবং নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করতে হবে। এর বাইরে গেলে অবৈধ হয়ে যেতে হয়। তখন মেয়াদ থাকলেও ফেরত পাঠানো হবে।

শেয়ার করুন