সৌদিতে `ফ্রি ভিসা’র নামে শ্রমিক পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বন্ধ করে দেয়ার কথা জানিয়েঝছন রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী।
রামরু চেয়ারম্যান জানান, ‘সৌদি সরকার অভ্যন্তরীণ চাপ কমাতে গণহারে বিদেশিকর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। সরকারসহ সংশ্লিষ্টপক্ষগুলো বুঝতে পেরেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেনি। আমরা শুধু লোক পাঠানোর পরিসংখ্যান দেখি। এটা সৌদি আরবে ভুল বার্তা ছড়িয়েছে। এখন সবার উচিত হবে, নতুন শ্রম খোলার দিকে নজর দেয়া। সংশ্লিষ্ট দেশের উপযোগী শ্রমিক তৈরি করে লোক পাঠানো। ব্যবসা করতে চাইলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেই নতুন নতুন মার্কেট খুঁজে বের করতে হবে।’
আর সংকট কাটাতে সৌদি আরবে জেলায় জেলায় মাইগ্রেশন সার্ভিস সেন্টার, বহির্গমনের আগে শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, নিয়োগদাতার যোগ্যতা যাচাইয়ের কথা বলছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা।
সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হলেও ঝুঁকিতে রয়েছেন এ দেশের শ্রমিকরা। সুখের আশায় সহায়-সম্বল বেচে দেশটিতে গেলেও বাংলাদেশি অনেক শ্রমিক প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেশটিতে গিয়ে টিকতে না পেরে একরকম নিঃস্ব অবস্থায় ফিরছেন অনেকে। সৌদিকরণ-পরবর্তী সময়ে প্রবাসী শ্রমিক নিয়ে দেশটির সরকারের অব্যবস্থাপনাও এর পেছনে দায়ী বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। অনেকের অভিযোগ, কাজের অনুমতিপত্র (ইকামা) ও ভিসা থাকা সত্ত্বেও জোর করে ফেরত পাঠাচ্ছে দেশটি। তবে এও অভিযোগ উঠেছে, দেশটির পরিবর্তিত অবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার, জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সি ও অধিকাংশ শ্রমিক ব্যর্থ হচ্ছে। প্রবাসী আয় নিয়ে সরকারের গর্ব থাকলেও শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় ভাষাগত ও কর্মজ্ঞান দিতে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেয়া হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সহযোগিতায় সৌদি আরব থেকে শুধু অক্টোবর মাসেই ৮০৪ শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির হিসাবে, চলতি বছর দেশটি থেকে ১৮ হাজার শ্রমিক খালি হাতে ফিরেছেন। ২০১৭ সাল থেকে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করলেও একে অন্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আশানুরূপ কোনো সমাধান করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদিতে শ্রমিক নির্যাতন ও ফেরত আসার ঘটনায় প্রধান কারণ হিসেবে দেশটির পরিবর্তিত পরিস্থিতি দায়ী। তবে সংকট আঁচ করতে পেরেও তা মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারায় বাংলাদেশ সরকার, জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সি, দূতাবাস এমনকি শ্রমিকরাও দায়ী।
সৌদিতে যে হালে শ্রমিকরা?
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সৌদি আরবে বর্তমানে কর্মরত আছেন ২৪ লাখ বাংলাদেশি। প্রতি বছর দেশটিতে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। এসব শ্রমিকের শতকরা ৯০ ভাগই অদক্ষ, যাদের মৌলিক ভাষা ও সংশ্লিষ্ট কর্মজ্ঞান থাকে না।
জেদ্দায় বসবাসরত প্রবাসী সাংবাদিক সাইফুল রাজীব সাংবাদিকদের জানান, অভ্যন্তরীণ বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় ৩৬টি পেশায় বিদেশিকর্মী ও ব্যবসা নিষিদ্ধ করে সৌদি আরব। এ সময় প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মসংস্থান হারান। একই সময় অন্যান্য পেশাতে প্রবাসী কর্মীদের মজুরি অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক সে সময় দেশে ফেরেন। অনেকে অবৈধ অবস্থায় অন্য কাজের চেষ্টা চালিয়ে যান, যাদের বড় অংশই এখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতন ও দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।
দেশটির রাজধানী রিয়াদে বসবাসরত আরেক প্রবাসী সাংবাদিক ফকির আল আমিন সাংবাদিকদের জানান, এক বছরের ব্যবধানে সৌদি আরব ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে গেছে। মেয়েরা গাড়ি চালাচ্ছে, দোকান, হোটেল, শপিংমলে চাকরি করছে। এসব পেশায় বিদেশিরা কাজ করতেন।’
তার মতে, বাংলাদেশি কর্মীদের পুলিশি হয়রানি ও দেশের ফেরার বড় কারণ, যে কাজের জন্য সৌদি গেছেন, তা না করে অন্য কাজে জড়িয়ে পড়া, যা দেশটির শ্রম আইনের পরিপন্থী।
সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসও একই কথা বলছে। গণহারে বাংলাদেশি শ্রমিক ফেরত আসা নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস গত সপ্তাহে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ স্পন্সরের বাইরে কাজ করে, পালিয়ে যায় কিংবা ইকামা, বর্ডার ও শ্রম আইনের কোনো ধারা ভঙ্গ করে, তাহলে তাকে আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করে সৌদি সরকারের অর্থায়নে ডিপোর্টেশন সেন্টারের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারে। এছাড়া সৌদি সরকার সম্প্রতি কিছু পেশা ও খাতে সৌদিবিনা অন্য শ্রমিকদের কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় ওইসব পেশায় যদি কোনো প্রবাসী নিযুক্ত থাকেন, তিনি অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ রকম অবৈধ প্রবাসীদেরও সৌদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আটক করে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কেউ নির্দোষ দাবি করলে তাকে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগেরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
কয়েকজন সৌদিফেরত ভুক্তভোগী জানান, কাজের অনুমতি থাকার পরও গত সপ্তাহে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন কুড়িগ্রামের আকমত আলী। তিনি জানান, ‘সাত মাস আগে ক্লিনার হিসেবে কাজ করার জন্য সৌদিতে নেয়া হয়। সেখানে গিয়ে ওই কাজ না দিয়ে মাল ওঠা-নামার কাজ দেয়া হয়। ১৫ দিন ওই কাজ করে শরীরে ঘা হয়ে গেছে। পরে কোনোমতে তিনি পালিয়ে বিল্ডিংয়ের কাজে লাগেন। এজন্যই পুলিশ তাকে ধরে পাঠিয়ে দিয়েছে।’ একই বক্তব্য গোপালগঞ্জের সম্রাট, আলামিন ও আবদুল আজিজের।
প্রবাসী সাংবাদিকরা জানান, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের কিছু অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশে ফ্রি ভিসার নামে লোক নেয়। এতেই প্রথম বিপত্তি ঘটে। ওই ব্যক্তিকে সৌদি গিয়ে ইকামা (কাজের অনুমতিপত্র) করতে হয়, যার খরচও অনেক। কিন্তু যে কাজ দেয়া হয় তার পারিশ্রমিক সীমিত। এজন্য অধিক আয়ের আশায় নির্ধারিত কাজের বাইরেও বাংলাদেশি শ্রমিক বাড়তি সময় কাজ করেন। সড়ক-ফুটপাতে সবজি ও মুরগি বিক্রি, ফেরিওয়ালার কাজ করেন, যা সৌদি আইনের পরিপন্থী। এছাড়া সরাসরি নিজেদের ব্যবসা নিষিদ্ধ থাকায় অনেক বাংলাদেশি সৌদি কোনো ব্যক্তির নামে এ ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে অনেক সময় সৌদি ওই ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
পরস্পরবিরোধী দূতাবাস–সরকার–এজেন্সি
সৌদি আরবে শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা বহু পুরনো হলেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশি দূতাবাস নিষ্ক্রিয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সদস্য আবদুল আলিম সাংবাদিকদের জানান, ‘সৌদি সরকারের সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক আলোচনা করার মতো দক্ষ লোক এখনো আমাদের নেই। ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনামের লোক নির্যাতন হলে সৌদিকে জবাবদিহি করতে হয়, কিন্তু আমাদের এ দক্ষতা এখনো হয়ে ওঠেনি।’ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের জানান, ‘২৪ লাখের বিশাল শ্রমিক দেখা ছাড়াও দূতাবাসকে আরও অনেক কিছু দেখতে হয়। কিন্তু আমাদের জনবল সে তুলনায় সীমিত।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শহিদুল আলম জানান, ‘সৌদি আরবের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমাদের শ্রমিকরা বিপদে আছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জেনে বুঝে ফ্রি ভিসার নামে লোকজন নিয়ে বিপদে ফেলছে এজেন্সিগুলো। আমরা একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ তৈরি করছি। এখন থেকে লোক পাঠাতে হলে ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত লোক ছাড়া পাঠানো যাবে না।’
বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী জানান, ‘সৌদিতে প্রায় অর্ধেক লোক তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে এসেছেন। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে নিয়োগদাতারা কেন শ্রমিকের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এই প্রশ্ন করার দায়িত্ব সরকারের। যেহেতু সরকার বিপুল টাকা পাচ্ছে এই খাত থেকেই। আমাদের শ্রমিকের নিরাপত্তার বিধান সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের হাতে। একইভাবে বাংলাদেশেও এই তিন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি সমন্বয় করতে হবে। অথচ এসব শ্রমিকের সচেতনতা, দক্ষতা, বাড়াতে বিনিয়োগ কোথায়? সমস্যা সমাধানে দূতাবাসের জনবল বৃদ্ধি, সৌদি আরবের প্রত্যেক জেলায় মাইগ্রেশন সার্ভিস সেন্টার করতে হবে, যাতে শ্রমিকরা বিপদে পড়লে সমাধান দেয়া যায়। এমনকি শ্রমিকরা যাওয়ার আগেও ওই দেশের আইন, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’
পূর্বকোণ-রাশেদ