চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রেমিটেন্সে আছে, মরদেহে নেই

মোহাম্মদ আলী

১ নভেম্বর, ২০২২ | ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর ১৭৬টি দেশে এ পর্যন্ত বাংলাদেশি প্রবাসী গেছেন এক কোটি ৪১ লাখের বেশি। এর মধ্যে বছরে প্রায় ৬ হাজার প্রবাসীর মরদেহ দেশে আসে। কিন্তু এসব প্রবাসীর মরদেহ দেশে আনার খরচের দায়িত্ব নেয় না সরকার। প্রবাসে কাজ করা প্রবাসীদের মানবিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং স্বচ্ছল ব্যক্তি নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে দেশে স্বজনদের কাছে মরদেহ পাঠান। এ ক্ষেত্রে তাদের বিমানের ভাড়া গুনতে হয় স্বাভাবিক একজন যাত্রীর তুলনায় দ্বিগুণ। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ দূতাবাসে বছরের পর বছর ধরে ধর্ণা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। তাতে ক্ষোভ ঝরছে প্রবাসীদের।

 

 

প্রবাসী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, অসহায় কোন প্রবাসী রোগাক্রান্ত হয়ে বিদেশে মারা গেলে মরদেহ দেশে পাঠাতে দায়িত্ব নেয় না সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস। এ অবস্থায় রেমিট্যান্সযোদ্ধার মরদেহ পড়ে থাকে বিদেশের হাসপাতালের হিমঘরে। নিরুপায় হয়ে চাঁদা তুলে মরদেহ দেশে পাঠাতে বাধ্য হন প্রবাসী সংগঠন ও প্রবাসীরা। যদিও এক সময় বাংলাদেশ বিমান ফ্রি’তে রেমিটেন্সযোদ্ধার মরদেহ বহন করতো। কিন্তু লোকসানের অজুহাত তুলে ২০১৯ সালের দিকে মরদেহ পরিবহন বন্ধ করে দেয় বিমান সংস্থাটি।

 

 

প্রবাসীরা জানায়, প্রবাসীরা জীবন যৌবন কাটিয়ে দেন বিদেশে। রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেন। কিন্তু কোন কারণে প্রবাসে মৃত্যু হলে তাদের দায়িত্ব নেন না কেউ। এতে একদিকে দেশে স্বজনরা শোক ছাপিয়ে থাকেন উৎকণ্ঠিত, অপরদিকে প্রবাসীরা নিজের কাজ ফেলে চাঁদা তুলতে মাঠে নেমে পড়েন। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও প্রতিকারে এগিয়ে আসেনি সরকারের কোন মন্ত্রণালয়।

 

 

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মধ্যপ্রচ্যের দেশসমূহে। এখানে অর্ধ কোটির বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ সৌদি আরবে, ১৫ লাখ সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ৮ লাখ ওমানে, ৫ লাখ কুয়েতে, সাড়ে ৪ লাখ কাতারে এবং প্রায় চার লাখ বাহরাইনে। অপরদিকে আমেরিকায় রয়েছেন প্রায় ৮ লাখ প্রবাসী। তাদের কেউ প্রবাসে মারা গেলে মরদেহ দেশে পাঠাতে দায়িত্ব নেয় না সরকার। এ নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।

 

 

জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল আলম মজুমদার পূর্বকোণকে বলেন, বছরে প্রায় ৬ হাজার প্রবাসীর মরদেহ দেশে আসে। কিন্তু এসব প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে খরচ না দিলেও অন্য খাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী পরিবারকে এককালীন অনুদান দিচ্ছে। কোন প্রবাসীর মৃত্যু হলে তার পরিবারকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দুই মাসের মধ্যে এককালীন তিন লাখ টাকা এবং মরদেহ দেশে আসলে ৩৫ হাজার টাকার চেক বিমানবন্দরে স্বজনের হাতে তুলে দিচ্ছে।

 

 

এছাড়াও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পরে যারা চাকরির ভিসা নিয়ে বিদেশে গেছেন তারা এতদিন ধরে পেয়েছিলেন দুই লাখ টাকা করে। এটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ টাকা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে দেওয়া হচ্ছে চার লাখ টাকা।’

 

মরদেহ পাঠাতে দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে

মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী
সভাপতি চট্টগ্রাম সমিতি, ওমান

এনআরবি-সিআইপি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সমিতি ওমানের সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘ওমানে প্রায় ৮ লাখ প্রবাসী রয়েছেন। এর মধ্যে প্রতিমাসে ৪৫ থেকে ৫০ জন প্রবাসীর মৃত্যু হয়। কিন্তু এদের মরদেহ দেশে পাঠাতে খরচের দায়িত্ব নেয় না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

 

বিগত পাঁচ বছর ধরে চট্টগ্রাম সমিতি, ওমান প্রায় ২০০ মরদেহ দেশে পাঠিয়েছে। ওমান থেকে একটি মরদেহ বাংলাদেশে পাঠাতে খরচ হয় এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। এ নিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রীর কাছে গিয়েছি। এমন কী প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সমাধান পাইনি।

 

মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, প্রবাসীদের প্রাণের দাবি হচ্ছে, কোন প্রবাসী বিদেশে মারা গেলে তার মরদেহ দেশে পাঠাতে যাবতীয় খরচ যাতে সরকার বহন করে। প্রবাসীরা বেঁচে থাকতেও সরকারের কাছ থেকে কিছু পায় না, মরলেও কিছু পায় না। এটা ভাবতে আমাদের খুব কষ্ট হয়।

 

 

দ্বিগুণ ভাড়ায় প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠায়

মোহাম্মদ ইয়াকুব সুনিক
প্রথম সহ-সভাপতি বাংলাদেশ এসোসিয়েশন, দুবাই

বাংলাদেশ এসোসিয়েশন দুবাই এর প্রথম সহ সভাপতি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশ বিজনেস এসোসিয়েশন আল আবিরের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াকুব সুনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রবাসীরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে বহু বছর ধরে আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন। এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণের রেমিটেন্স যায় বাংলাদেশে। কিন্তু প্রবাসীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলেও প্রবাসে কোন প্রবাসী মারা গেলে তার মরদেহ দেশে পাঠাতে সরকারের কোন বরাদ্দ নেই। তাই চাঁদা তুলে দ্বিগুণ বিমান ভাড়া দিয়ে স্বজনের কাছে মরদেহ পাঠায় প্রবাসীরা। অথচ সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য এদেশে আসেন। কিন্তু তারা নির্ধারিত কিছু অনুষ্ঠান করে দেশে ফিরে যান। প্রবাসীদের সমস্যা-দুর্দশার কথা শোনার জন্য তাদের সাথে কথা বলেন না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের সমস্যাগুলো জিইয়ে রয়েছে। তাতে ক্ষোভ বাড়ছে প্রবাসীদের।

 

মরদেহ দেশে পাঠাতে দায়িত্ব নেয় না সরকার

নুরুল আবছার বাবুল
সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য বাংলাদেশ কমিউনিটি, কাতার

 

চট্টগ্রাম সমিতি, কাতারের প্রেসিডিয়াম বোর্ড মেম্বার ও বাংলাদেশ কমিউনিটি কাতারের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নুরুল আবছার বাবুল পূর্বকোণকে বলেন, ‘কাতারে কোন প্রবাসীর মৃত্যু হলে এখানকার মানবিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো চাঁদা তুলে মরদেহ দেশে পাঠায়। বছরে পর বছর ধরে এ সমস্যা চলে আসলেও মরদেহের কোন দায়িত্ব নেয় না সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এটি এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কোন প্রবাসীর মৃত্যু হলে সবার থেকে চাঁদা তুলতে হয়। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কাতার থেকে একটি মরদেহ দেশে পাঠাতে বিমান ভাড়া, মরদেহ বক্স তৈরিসহ প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এ খরচ মেঠাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। অথচ এসব প্রবাসী জীবিত অবস্থায় দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর পর তাদের জন্য সরকার দায়িত্ব নেয় না। এটা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে প্রবাসীর মরদেহ সম্পূর্ণ ফ্রি’তে দেশে পাঠাতে।’

 

চাঁদা তুলে মরদেহ দেশে পাঠাতে ব্যবস্থা করি

এস এম ইকবাল ফারুক

সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক এর সাধারণ সম্পাদক এস এম ইকবাল ফারুক পূর্বকোণকে বলেন, ‘নিউইয়র্ক থেকে এক প্রবাসীর মরদেহ সম্প্রতি রাউজানে তার স্বজনের কাছে পাঠিয়েছি। কোন প্রবাসীর মৃত্যু হলে মরদেহ দেশে পাঠাতে খরচ বহন করে না সরকার। এটি প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই আমরা চাঁদা তুলে মরদেহ দেশে স্বজনদের কাছে পাঠাতে ব্যবস্থা করি। এটি নিয়ে সরকারতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে কোন প্রবাসী বিদেশে মৃত্যু হলে তার মরদেহ দীর্ঘদিন যাবত হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে না থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে সরকারকে এ মরদেহ দেশে পাঠাতে যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে অন্যান্য প্রবাসীরা মানসিকভাবে শান্তি পাবে।’

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট