চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

অসুস্থ প্রবাসীকে দুবাই থেকে আনলো না বিমান

প্রবাস ডেস্ক

২৬ মে, ২০১৯ | ১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

গত শুক্রবার (১০ মে) রাত ১১ টা। দুবাই এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-১ এর ২ নম্বর বুকিং এরিয়ায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাউন্টার। কাউন্টারের সামনে লালচে ভেজা দাগ। একটু কাছে চোখ নিলে বোঝা যায়, রক্তের ছাপ। এই ছাপ নজরে আসে বিমানের এক কর্মকর্তার। তখনই তিনি বুঝলেন, একটু আগে এক প্রবাসী কর্মী দেশে যেতে এসেছিলে বুকিং করাতে। যার পাযয়ে ব্যান্ডেজ ছিলো। তিনি মেঝেতে পা রেখেছিলেন এবং সেখান থেকেই এই দাগ।-সূত্র:প্রবাস বার্তা
ততক্ষণে ওই প্রবাসীকর্মী ইমিগ্রেশনের দিকে রওনাও হয়েছেন। বিমানের এক কর্মকর্তা তাকে ডেকে আনেন। হুইল চেয়ারে বসা ওই কর্মীর সাথে আরো দুজন। কঙ্কালসার দেহ । মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । মাথায় সাদা টুপি। বাম পায়ে ব্যান্ডেজ।
মধ্যবয়স্ক এই প্রবাসীকর্মীর নাম কলমদর আলী। তাকে ঘিরে বিমানের একজন কর্মকর্তা, এয়ারপোর্টের একজন কর্মী, আরো আছেন দুজন প্রবাসী। এই দুজন কলমদর আলীকে বিমানে উঠিয়ে দিতে এসেছেন। কোন সম্পর্ক নেই তাদের মধ্যে। অসহায় কলমদরকে সহায়তা করতে এসেছেন তারা।
সাথে থাকা দুজন ও কলমদর আলীর কাছে জানা যায়, ১৮ বছর প্রবাস জীবন পার করেছেন সিলেটের কলমদর আলী। বাম পায়ে সংক্রমণ (ইনফেকশন) হয়েছে। ডায়াবেটিস থাকার কারনে শুকাচ্ছে না সেই ক্ষত। যেই কোম্পানীতে কাজ করতেন, তারা দেশে পাঠানের জন্য রিলিজ দিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাও করিয়েছে তারা। কিন্তু পুরোপুরি সেরে উঠছে না বলে, দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে কোম্পানি।
বিমানের বিজি ২৪৮ ফ্লাইটে বিজনেস ক্লাসে টিকিট কেটে দিয়েছে কলমদরের কোম্পানি। অসুস্থতার সকল কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে বুকিংও শেষ করেছিল বিমান। কিন্তু ইমিগ্রেশনের দিকে হুইল চেয়ারে যাওয়ার পথে আটকে দেয়া হয় তাকে। কলমদর আলীর বসা হয়নি সেই আরামদায়ক আসনে।
বিমানের একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, এভাবে যাওয়া যাবে না। তখন কলমদরের আকুতি ভরা চাহনি। গুছিয়ে কথাও বলতে পারেন না। ছল ছল করছিল এই রেমিটেন্স যোদ্ধার চোখ। আর অনুরোধ করছিলেন, স্যার যেতে দেন না।
পায়ের ক্ষত ব্যান্ডেজ করা থাকলেও গোরালির নিচের অংশ ভেজা ছিল। বিমানের বুকিং কাউন্টারের সামনের ফ্লোরে কয়েক জায়গায় সেই ভেজা ব্যান্ডেজের দাগ। এতেই কপাল পুরল এই রেমিটেন্স যোদ্ধার।
বসা অবস্থায় পা দিয়ে কোন রক্ত বের হচ্ছিল না বা অতিরিক্ত ভেজাও ছিল না। সাথের দুজন অনুরোধ করছিলেন বিমানের এক কর্মকর্তার কাছে, ‘স্যার এখন তো রক্ত নেই। লোকটার কেউ নেই, কোম্পানী রিলিজ দিয়ে দিয়েছে। দেশে না গেলে তার (কলমদর আলী) অনেক সমস্যা হবে।’
কলমদর আলীর এই অবস্থা দেখছিলেন, গণমাধ্যমের সাংবাদিক মিরাজ হোসেন গাজী। অসহায় প্রবাসীর কাছে গিয়ে বসলেন তিনি। সব শুনে নিজের পরিচয় দিয়ে তিনিও অনুরোধ করলের বিমানের দুই কর্মকর্তাকেই। কান্ট্রি ম্যানেজার মি. আমিনুল এর কাছেও অনুরোধ করলেন সাংবাদিক মিরাজ। বললেন, “এখনতো রক্ত নেই, প্রযয়োজনে একটি পলিথিন দিযয়ে পা বেঁধে দেই। দেখেন তাহলে ওনাকে যেতে দেয়া যায় কি না ?”
কর্মকর্তার জবাব, “ভাই দেখেন, যদি ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে কী হবে ? ইনফেকশন আছে পায়ে, গন্ধ বের হলে কী করবো তখন ?”
সাংবাদিক বললেন, পলিথিন পেঁচিয়ে দিলেতো রক্ত বের হলেও বাইরে পরবে না।
এবার তিনি বললেন, ‘আচ্ছা দেখি।’
ঘুরে এসে সাংবাদিকের সাথে কথা বলছিলেন বিমানের কিন্ট্রি ম্যানেজার। এক পর্যায়ে বুকিং কার্ড দেখতে চাইলেন। দেখে বললেন, ‘ভাই আপনার আসনতো অনেক পিছনে। দেন দেখি সামনে দিতে পারি কিনা।’
মিরাজ হোসেন গাজী বললেন, “ভাই আমার এই আসন পরিবর্তেন চেয়ে অনেক খুশি হবো, যদি লোকটাকে (কলমদর আলী) নিতে পারেন।” কিন্তু শেষ পর্যন্তও কলমদর আলীকে নিলো না বিমান।
বিমানে উঠার আগ মুহূর্তে আবারও বিমানের কর্মকর্তার সাথে দেখা হয় সাংবাদিকের। এবার তিনি আসন পরিবর্তন করে কার্ডটি ঠিক করে দিলেন। তখনও মিরাজ হোসেন গাজী বললেন, “ভাই মনটা অনেক খারাপ লাগছে, লোকটাকে সাথে করে নিতে পারছি না।” বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার বললেন, “ভাই, আমারও খারাপ লাগছে, কিছুই করতে পারলাম না। চাকরি করি তো। নিয়মের বাইরে যেতে পারছি না।”
মিরাজ হোসেন গাজী বলেন, “বিমানের ভিতরে ঢুকেই দেখি, বিজনেস ক্লাসে একটি আসন ফাঁকা । যেটা কলমদরের । কিন্তু টিকিট কেটে, বুকিং সম্পন্ন করেও আসনটিতে জায়গা হয়নি অসুস্থ রেমিটেন্স যোদ্ধার। দেশে যাওয়া হলো না এক প্রবাসীর। জানি না জীবিত দেশের আলো বাতাস জুটবে কিনা কলমদর আলীর।”
শেষ পর্যন্ত অসুস্থ প্রবাসী কলমদর আলীকে দুবাই এয়ারপোর্টে রেখেই আকাশে উড়লো বিমান বাংলাদেশ এযারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি-২৪৮।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট