চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে ঈদ

শামসুল আরেফিন

৪ মে, ২০১৯ | ২:৩০ অপরাহ্ণ

প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের মানুষ, সেদেশ বা অঞ্চলের ভাষা-উপভাষা ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোন দেশ বা অঞ্চলের কোন ধর্মীয় জনগোষ্ঠী বিশেষ কোন উৎসব পালন করতে থাকলে এই উৎসব দ্বারা সেদেশ বা অঞ্চলের ভাষা-উপভাষা ও সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়। ফলে উক্ত ভাষা-উপভাষায় সৃষ্টি হয় মনোমুগ্ধকর গান বা সাহিত্য। ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে ঈদ’ শীর্ষক এই লেখায় ঈদ উৎসবের প্রভাবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গান তুলে ধরতে সচেষ্ট হবো। তবে তার আগে ঈদ উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে চাই।
আরবে জাহেলিয়া নামক চিহ্নিত যুগে বিভিন্ন মেলা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এক্ষেত্রে মদিনার মেহেরজান ও নওরোজ এবং হজরত মুহাম্মদের জন্মস্থান মক্কার উকাজ মেলা উল্লেখযোগ্য। এসব আয়োজন আরবদের সংস্কৃতি-চর্চা ও শিল্প-সাহিত্যের উর্বরতা সম্পর্কে আমাদের জানান দেয়। তখন আরবরা দেশভ্রমণ, যুদ্ধবিদ্যা, বাণিজ্য, অতিথি-আপ্যায়ন, পশুপালনেও পারদর্শী ও আন্তরিক ছিল বলে ইতিহাসসূত্রে জ্ঞাত হওয়া যায়। তবে তাদের সংস্কৃতি-চর্চা ও শিল্প-সাহিত্য আজও মানুষকে আন্দোলিত করে। উকাজ মেলা ‘সাহিত্য সম্মেলন’ হিসেবে ইতিহাসখ্যাত। যে-মাসগুলোতে যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল, তখন উকাজ মেলা অনুষ্ঠিত হতো। তখনকার সময়ে এই মেলা আরবদের কাছে মত বিনিময়ের শিক্ষায়তন হিসেবেও গণ্য হতো। প্রাক-ইসলাম যুগের আরবের প্রসিদ্ধ এই মেলায় কবিরা তাঁদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। শ্রেষ্ঠ কবিতাটি কাবার দরজায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে টাঙিয়ে রাখা হতো বলে এর নাম ছিল মুআল্লাকা। উকাজ মেলায় যাঁরা শ্রেষ্ঠ কবিতা পাঠ করেন তাঁরা হলেন ইমরুল কায়েস, আনতারা বিন সাদ্দাদ, আমর ইবনে কুলসুম, ত্বরফা বিন আল আবদ, হারিস বিন হিল্লিজা, যুহাযের বিন আবি সুলমা, লাবিদ বিন রাবিয়া। উকাজ মেলায় তাঁদের পঠিত শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো নিয়ে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে ‘মুআল্লাকা’ নামে সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলক হাম্মাদ আল রাবিয়া। এই সংকলনের কবিতাগুলো আরবদের কাছে আজও মনোমুগ্ধকর ও অনন্যসাধারণ। কেবল কি তা’ই ? ‘মুআল্লাকা’-র কবিদের মধ্যে ইমরুল কায়েস আজও আরবদের কাছে আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর পুরো নাম ইমরুল কায়েস বিন হুযর আল কিন্দি। আরবের নজদ এলাকায় জন্মগ্রহণকারী এই কবি ছোটকালে কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করায় তাঁর পিতা তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তারপর তিনি কবিতা রচনা অব্যাহত রেখে বন-জঙলে ঘুরে বেড়িয়ে জীবন-যাপন করেন। তিনি সর্বদা প্রচুর মদ পান করতেন এবং উনাইযা নামে তাঁর এক প্রেমিকা ছিল। আনুমানিক ৫৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
যা হোক, প্রাক ইসলাম যুগে আরবের এই যে সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক পরিবেশ এবং তাতে আরবদের যে-আনন্দ ও উল্লাস, ইসলামের প্রবর্তনের পরে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। হজরত মুহাম্মদ মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মনে করলেন, ইসলামের অনুসারিদের জন্য আলাদা আনন্দ অনুষ্ঠান প্রয়োজন। ফলে মদিনায় হিজরত করার দ্বিতীয় বছরে, ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে, তিনি ঈদ উৎসবের (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) সূচনা করেন। হিজরি বর্ষের রমজান মাসে একমাস রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসের এক তারিখে ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। জিলহজ মাসের দশ তারিখে পালিত হয় ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতরে সবধরনের বৈষম্য, হিংসা-বিদ্বেষ-বিভেদ-অহংকার-ঝগড়া-মারামারি-হানাহানি ভুলে মুসলমানরা ঈদগাহে আল্লাহ্র কাছে নিজেদের সমর্পণ করবে, তারপর কোলাকুলির মাধ্যমে একে-অপরকে আপন করে নেবে, ঘরে ঘরে গিয়ে ভাল খাবার গ্রহণ করবে, এটাই নিয়ম। ঈদুল আজহা হলো কুরবানির ঈদ। তাতে গরু-ছাগল প্রভৃতি আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে কুরবানি দেওয়া হয়।
দুই.
ঈদ উৎসবের উৎপত্তির পর থেকে মুসলমানরা দেশে দেশে এই উৎসব পালন করে আসছে। বলেছি, কোন দেশ বা অঞ্চলের কোন ধর্মীয় জনগোষ্ঠী বিশেষ কোন উৎসব পালন করতে থাকলে এই উৎসব দ্বারা সেদেশ বা অঞ্চলের ভাষা-উপভাষা ও সংস্কৃতি প্রভাবিত হওয়ায় উক্ত ভাষা-উপভাষায় সৃষ্টি হয় মনোমুগ্ধকর গান বা সাহিত্য। ঈদ উৎসবের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, নানা দেশের মুসলমানরা কালে কালে ঈদ উদ্যাপন করার কারণে দেশগুলোর ভাষা-উপভাষা ও সংস্কৃতি তা দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছে। ফলে এসব ভাষা-উপভাষায় এই ঈদ উৎসব নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গান, কবিতা, গল্প প্রভৃতি। বাংলা ভাষায় ঈদ উৎসব নিয়ে জাতীয় কবির রচিত গান, কবিতা প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। জাতীয় কবির ঈদুল ফিতর কেন্দ্রিক ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ শীর্ষক গানতো এদেশের মুসলমান কেবল নয়, হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের মুখে মুখে।
ঈদ উৎসব দ্বারা চট্টগ্রামের উপভাষা অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষা প্রভাবিত হতে শুরু করে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে এদেশে ইসলামের প্রচলন হয় বলে ধারণা করা হয়। বস্তুত অষ্টম শতকে বা তার আগে অথবা তার পরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সুফিরা এসেই এদেশে ইসলামের প্রচলন করেন। চট্টগ্রামেও তখন থেকে ঈদ উৎসব অর্থাৎ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালিত হচ্ছে এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এই উৎসব দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে বলে আমাদের অনুমান।
প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামে সম্ভবত ঈদুল ফিতরে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দ অনুষ্ঠান হয় বেশি। প্রাচীনকালে এই অনুষ্ঠান চট্টগ্রামে কিভাবে পালিত হতো সম্যক জানা না গেলেও আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, চট্টগ্রামে নিকট অতীতে ঈদুল ফিতরে মুসলমান ছেলে-মেয়েরা স্থানীয় সংস্কৃতি অনুসারে নতুন কাপড়-চোপর পরিধান ও আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠতো। মেয়েরা সেদিন সালোয়ার-কামিজ ও ছেলেরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিধান করতো। সেদিন ঘরে ঘরে সেমাই, শিরনি, ফিরনি, লাউয়ের মোরব্বা, গুড়া পিঠা প্রভৃতি মিষ্টিজাতীয় খাবার প্রস্তুত করা হতো। বর্তমানে ছেলে-মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ ও পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ নানা ডিজাইনের চমৎকার সব পোশাক পরে। ঘরে ঘরে আন্নি বিরিয়ানি, নুডল্স, চটপটি, চনা, হালিম, পায়েস, ফালুদা, পুডিং, মোরগ পোলাও প্রভৃতি তৈরি করা হয়। ছেলে-মেয়েরা ঘরে ঘরে গিয়ে বড়দের সালাম করে সেলামি নেয় এবং এসব খাবার গ্রহণ করে গভীর তৃপ্তি অনুভব করে। ঈদুল ফিতরের আনন্দকে বহুগুণে বৃদ্ধি করার জন্য চট্টগ্রামের পত্র-পত্রিকাগুলো ঈদসংখ্যা এবং সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে।
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত চট্টগ্রামে মুসলমানদের মধ্যে এই অঞ্চলের ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে এত ব্যাপকভাবে ঈদ উৎসব পালিত হলেও আজ একথা না বলে উপায় নেই যে, প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগের পর পর্যন্ত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই ঈদ উৎসব নিয়ে কোন গান অলক্ষ্য, এমনকি বর্তমানেও এই উৎসব নিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান রচিত হয়েছে হাতে গোনা। আমাদের সংগ্রহে এম এন আখতার রচিত একটি ও শাহীন নূপুর রচিত একটি গান রয়েছে। এম এন আখতার তাঁর গানটি বাংলা ভাষায় রচনা করে পরবর্তীতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নিম্নোক্তরূপে অনুবাদ করেন:
চাঁদর ওঁয়ারে বহুত তারা ঈদর মেহমান,
নাচানাচি গরের আইজ খুশিতে আঁর পরান।

মাসর আগে লেইখ্যদে, পইলা রমজান
ঈদুর চাঁদ আইবু ফিরি, পইলা শাবান
এই হথাল্লাই সাজাই রাইখ্যি মহব্বতর গান।

কারে কণ্ডে বইসতু দিয়ুম, কণ্ডে যে রাখি,
পাকর ঘরত বহুত রান্না, আঁই দিয়ুম কী?
ত আঁর হইছালি অর বাঁচিবু কি মান?

খাওন-দাওন বাদ দিয়েরে থাইক্যি উদাস মনে,
পুরোওয়া মাস পার গরি দি চাইয়্যেরে পথপানে,
এক নিমিষে অই গেল আঁর দুঃখুর অবসান।

শাহীন নূপুর রচিত গানটি:

আইস্যেরে ঈদ তোঁয়ার ঘরত খুশির তো আর সীমা নাই,
কথ কিছু কিনিবা তুঁই তোঁয়ার পোয়া-মাইয়ারলাই,
আঁই অভাগা কাঁদি মরির আঁর পোয়া-ছার মুখখান চাই।

ঘরত তো নাই ট্যাঁয়া-পৈসা কত্তুন দিয়ুম নোয়া হড়,
ঈদর খুশি দালান কোটাত, আঁর আছেদে ভাঙ্গা ঘর;
দিন কাডে আঁর মিন্নত গরি এই পোয়া-ছার ভাতল্লাই।

নোয়া জামা, নোয়া জুতা দিত্ ন পাইরগুম বুলি
আঁর পোয়া-ছা কাঁদেররে চোগর দুয়ার খুলি;
কারে পাইয়ুম এই পোয়া-ছার দুখ বুঝিবাল্লাই?

তথ্যসূত্র:
১. হিস্ট্রি অব অ্যারাবস, পি কে হিট্টি
২. ঈদ উৎসব, ড. এম এ সবুর, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০৩ জুলাই ২০১৬
৩. ইসলামে সংস্কৃতিচর্চার স্বরূপ, মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৪ এপ্রিল ২০১৭
৪. ব্যক্তিগত অনুসন্ধান

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট