চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ঈদুল ফিতর ও অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

৪ মে, ২০১৯ | ২:১৭ অপরাহ্ণ

ঈদুল ফিতর ও অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
মাহে রমজান মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্ম সংযমের অভিনব পন্থা অবলম্বনে সিয়াম সাধনা পবিত্র ইসলামের বিধিবদ্ধ ইবাদত যা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত দীর্ঘ এক মাস দেহ ও মনের পরিশুদ্ধতার যে পরীক্ষা, তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ঈদের নিরন্তর আনন্দ উৎসবে। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে পালিত হয় এই উৎসব যা ঈদুল ফিতর হিসেবে পরিচিত। নামায, ইফতার, সেহেরী, পবিত্র কোরআন পাঠ, যাকাত প্রদান, নতুন কাপড় কেনাও পরিধান করা, উপহার বিতরণ ও বিনিময় ইত্যাদি সম্পন্ন করে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টিতে নিজেকে বিলীন করার আত্মতৃপ্তিতে সমৃদ্ধ ঈদুল ফিতরের এই উৎসব।
কারো সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্বের নবতর উপযোজনে সার্থক হয়ে ওঠে এ আনন্দ উৎসব। ধনী, গরীব নির্বিশেষে এই উৎসবের মাত্রিকতা যেমন ভিন্ন, সমাজ পরিবর্তনের আধুনিক পর্যায়ে এসে এই উৎসব এক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বিকশিত। মাহে রমজানের এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মূলে রয়েছে শাশ্বত বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দের যোগসূত্র যা ব্যক্তিকে মানবিকতায় ও নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ করে এক সুষম সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘হিন্দু-মুসলমান’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, “একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন, দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটাযায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটাবে কে?” নজরুল আরো বলেছেন, “ন্যাজ যাদের ইগজায়- তার ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোকÑতারা ইহয়ে ওঠে পশু। যে সব ন্যাজওয়ালা পশুর হিংস্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে শৃঙ্গরূপে, তাদের তত ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে যাদের হিংস্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি।”
নজরুলের উল্লেখিত হিংস্রতাকে নিধন করার উপযোগী পন্থাই হচ্ছে মানবতারচর্চা। অন্যের কষ্টে ব্যথিত না হওয়া, অন্যের হৃদয়ের রক্তক্ষরণে নিজের হৃদয়ে বেদনার জন্ম না নেওয়া ইত্যাকার অমানবিক, অশুভ ও অসংগতিপূর্ণ আচরণ সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাকে কতটুকু বিপর্যস্ত করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদ উৎসবের শিক্ষা এই মানবতাকে জাগ্রত করার জন্য কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি নতুন করে বলার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। তবুও এখনো যখন ধর্মীয় উম্মাদনায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো নানা অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেত তখন দুঃখের সাথে নজরুলের উল্লেখিত বাণীগুলো বার বার স্মরণে আঘাত করে।
বস্তুতপক্ষে সামাজিক বিধিসমূহ প্রতি পালনের মাধ্যমে সমাজ-পরিবেশকে বাসযোগ্য করা এবং নানাবিধ সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করে মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠাই মানুষের ধর্মের মৌলিক উদ্দেশ্য। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ঘৃণা, সহানুভূতি ইত্যাদির ব্যক্তিগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট মনোভাব সামাজিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সাধারণত মনোভাব তিন ধরনের হতে পারে-প্রথমত- স্নেহ, প্রীতি, কৃতজ্ঞতা, ভদ্রতা এবং উপরোল্লেখিত বিষয়সমূহ সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। দ্বিতীয়ত আতঙ্ক, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণা, ঔদ্ধতা, সন্দেহ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার পথে কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকরে।
তৃতীয়ত প্রতিদ্বন্দ্বীতা, প্রতিযোগিতা, আধিপত্যবাদ, অবৈধ-অনৈতিক প্রভাব বিস্তার, নানাবিধ অর্থসম্পদ ও ক্ষমতার লোভ লালসা সামাজিক বন্ধনকে করে দৃঢ়ভাবে কুলষিত, অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত এবং অগ্রহণযোগ্য। এই সব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যেই অভিন্ন লক্ষ্যবস্তু বা সর্বজনীন বিষয়সমূহকে আত্মস্থ করার প্রসঙ্গটি অত্যধিক জরুরী। এই ক্ষেত্রে সামাজিক আচার-আচরণকে সমাজযোগ্য করার পন্থাগুলো যেমন শিক্ষা ও ধর্মীয় ব্যবস্থা, যৌক্তিক প্রেষণা, ইতিবাচক মনোভাব ইত্যাদির সহজ প্রবৃত্তির অনুশীলন সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।
পারস্পারিক মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা এবং আস্থা বৃদ্ধির পথ প্রশস্তকরণ দারুণভাবে ইতিবাচক সমাজপ্রতিষ্ঠার নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত। ঈদ উৎসব বা পূজাপার্বণে ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত, ধনী-গরীব নির্বিশেষে মানুষকে মানুষের মর্যদায় আসীন করার মধ্যেই প্রকৃত ধর্মের বাণী উচ্চারিত। বাঙালির ঈদ উৎসব বা সকলকে নিয়ে আনন্দের ভাগাভাগিতে মেতে ওঠা, নাচ, গান, নাটক, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদির সমন্বয়ে এটিকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাঠামোতে না রেখে ধর্মনিরেপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উপস্থাপিত হলেই এর মর্যাদা এবং তাৎপর্য অনেক বেশি মহিমান্বিত হবে-সেটিই স্বাভাবিক। এভাবেই মানব সমাজের বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুশাসন এবং অনুশীলন সামাজিকসম্পর্কের গঠন ও অভিজ্ঞতাকে নতুন মাত্রিকতায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে আরোপ করে আসছে।
মোতাহের হোসেন চৌধুরীরচিত ‘সংস্কৃতি-কথা’ অনুসারে-‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।’এভাবেই ধর্মের বিশ্বজনীনতা মানবিক তাকেই গুরুত্বসহকারে গ্রহণের মাধ্যমে প্রত্যেকধর্মের উৎসবগুলোয় নতুন প্রাণসঞ্চার করে আস্থা ও বিশ্বাসের পথকে সুপ্রশস্ত করার জন্যই অন্যান্য উৎসবের মত ঈদ উৎসব। এটিকে আরো অধিকতর উপভোগ্য করার লক্ষ্যে বঞ্চিত ও নিপীড়িত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সম্পৃক্ত করাই হোক অসাম্প্রদায়িকতার মানদন্ড।
সফিস্ট দার্শনিক প্রোটোগোরাসের বিখ্যাত উক্তি হল :‘Man is the measure of all things’। এটি ইতিহাস সমৃদ্ধ যে সকল ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য, বৈভব বা ক্ষমতা কোন কিছুই মানুষের মানবিক শক্তিকে সংকুচিত করতে পারেনা অথবা এক্ষেত্রে ব্যক্তি মানসের নিষ্প্রভ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। যেহেতু ইসলাম একটি সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন ধর্ম, পবিত্র কোরআনে মহানস্রষ্টাকে বলা হয়েছে রাব্বুল আলামিন অর্থাৎ সর্বমানবের স্রষ্টা । বলা হয়নি রাব্বুল মুসলেমিন অর্থাৎ শুধু মুসলনমানদের স্রষ্টা। তাই মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর প্রেরিত-পুরুষ আমাদের প্রিয় নবীর প্রতি ন্যূনতম বিশ্বাসী ব্যক্তি কখনো অন্য ধর্ম বা অন্য ধর্মের অনুসারীদেরকে অবজ্ঞা করতে পারে না। আর সেটি হলে তা হবে নিছক অধর্মেরই পরিচায়ক।
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র এই তিনটি ক্ষেত্রেধর্মের ভূমিকাকে ব্যক্তির স্বাভাবিক ধর্মাশ্রয়ী মানসিক ও সামাজিক গঠন দ্বারা সীমাবদ্ধ না রেখে এটাকে অবারিত করে পার্থিব এবং অপার্থিব ভাব ধারায় যেন মানুষের আবেগ প্রসূত কর্মকা-কে সকলের কল্যাণে একীভূত করা যায়, সে লক্ষ্যেই ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে পরিচালিত করাই হবে আধুনিক অসাম্প্রদায়িক ধর্মবিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি। ধর্মের অপব্যবহারকে সমাজ বারাজনীতিতে নিরোধ করার লক্ষ্যে সকল শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মীয় ব্যবস্থাসহ ইত্যকার বিষয়সমূহকে গণতান্ত্রিক উদারনৈতিক আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ভাবধারায় প্রবাহ মান করতে হবে। তাহলেই ঈদ উৎসব হবে সর্বজনীন সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। আর এটিহবে ঈদ উৎসবের মূখ্য সার্থকতা ও পরিপূর্ণতা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট