চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

বাঙালি সংস্কৃতির ব্যতিক্রম অনুষঙ্গ

ঈদুল ফিতর

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

৩ জুন, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আর্ত, অর্থার্থী, ভক্ত ও জিজ্ঞাসু- মানস চরিত্রকে এই চার ধারায় বিশেষিত করে বেদ ও গীতায় এর বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ¯্রষ্টার কাছে বিপদ থেকে পরিত্রাণ নিবেদনে ব্যতিব্যস্তরা হচ্ছে ‘আর্ত’ শ্রেণির লোক। অভাব বা ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে যারা আরাধনা করে তারা হচ্ছে ‘আর্থার্থী’। বিনাশর্তে ¯্রষ্টার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণে নিয়োজিত ব্যাক্তিরা হচ্ছে ‘ভক্ত’। আর নানাবিধ প্রক্রিয়ায় স্রষ্টার মহিমাকে উপলব্ধি করার জন্য যারা অনুসন্ধিৎসু তারা হচ্ছে ‘জিজ্ঞাসু’। অর্থাৎ যারা সত্যিকার ধার্মিক তারা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত না হয়ে মহান ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে ইহ-জাগতিক সকল কিছুকে বিসর্জন দিয়ে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের পন্থায় নিজেকে সমর্পণ করে তারাই প্রত্যেক ধর্মের কাছেই অতীব গ্রহণযোগ্য অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক। তারাই প্রকৃত অর্থে ¯্রষ্টার ভক্তকুল।
আমাদের সকলের জানা যে, পবিত্র রমজান মাসে ধার্মিক মুসলমান মানব সত্তার আতিœক উৎকর্ষ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিশিষ্ট উপাদান হিসেবে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে উনত্রিশ বা ত্রিশ দিন রোযা আদায় করেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শরিয়তের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে রোযা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০-৫০০০ বছর কালের আদি পিতা হযরত আদম (সাঃ) থেকে হযরত ঈসা (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবী রাসুলের শরিয়তেও তাদের উম্মতগণের উপর রোযা আদায় করা বিধিবদ্ধ ছিল। নিজের ও অপরের জীবন সমৃদ্ধিতে নিবেদিত সকল কর্মেরই যোগফল হচ্ছে ধর্ম-এই অমিয় সত্যকেধারণ করে যে কোন ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ ধর্মের গোঁড়ামি বা ধর্মান্ধতাকে পরিহার করে প্রকৃত ধার্মিকতার নির্যাসকে প্রাধান্য দিয়ে ¯্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য রোযা আদায় করে থাকেন।
রোজা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা ও সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্থ হওয়া। মহিমান্বিত রমজান মাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় সূখ-ভোগ থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে ইসলামী পরিভাষায় সিয়াম সাধনা। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের মাধ্যমে স্বীয় দেহ-মনকে নিয়ন্ত্রণ এবং এর পরিপূর্ণ উপলব্ধিতে অপরের কল্যাণকে নিশ্চিত করার মধ্যেই রমজানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপিত। আমাদের হয়ত এটিও জানা আছে যে, নামায, ইবাদত, সিজদা ইত্যাদি ফিরিশতা, জিন্সহ অন্যান্য মাখলুক্বও সম্পন্ন করে থাকে।
কিন্তু রোযা একমাত্র মানবজাতির জন্যই স্বতন্ত্র ইবাদত যা ঈমানের অঙ্গ হিসেবে ফরয বা অবশ্যই পালনীয়। এই মাসে রোযা পালন, ইফতার-সেহেরি গ্রহণ, যাকাত প্রদান ইত্যাদি কর্মকা- শুধু নিজের উৎকর্ষকতা অর্জনের জন্য নয়, বিভিন্ন মাত্রিকতায় নিজস্ব সম্প্রদায় ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের বা ভিন্ন মতামতের জনগোষ্ঠীর সাথে সৌহার্দ, সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব তথা বিশ্বজনীন মানবতাবাদকে ধারণ করার এক অবর্ণনীয় সুবর্ণ সৃষ্টির মাস। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মহা মানব বাণীকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে অন্যের পানাহারসহ নানাবিধ কষ্টের উপলব্ধি এক নতুন মাত্রায় মানবজাতিকে প্রতিষ্ঠিত করেযা সমাজের পারষ্পারিক আপোষ, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনকে পরিপূর্ণভাবে প্রাণিত করে।
মাহে রমজান মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের অভিনব পন্থা অবলম্বনে সিয়াম সাধনা পবিত্র ইসলামের বিধিবদ্ধ ইবাদত যা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত দীর্ঘ একমাস দেহ ও মনের পরিশুদ্ধতার যে পরীক্ষা, তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ঈদের নিরন্তর আনন্দ উৎসবে। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে পালিত হয় এই উৎসব যা ঈদুল ফিতর হিসেবে পরিচিত। নামায, ইফতার, সেহেরি, পবিত্র কোরআন পাঠ, যাকাত প্রদান, নতুন কাপড় কেনা ও পরিধান করা, উপহার বিতরণ ও বিনিময় ইত্যাদি সম্পন্ন করে মহান ¯্রষ্টার সন্তুষ্টিতে নিজেকে বিলীন করার আত্মতৃপ্তিতে সমৃদ্ধ ঈদুল ফিতরের এই উৎসব।
কারো সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্বের নবতর উপযোজনে সার্থক হয়ে ওঠে এ আনন্দ উৎসব। ধনী, গরীব নির্বিশেষে এই উৎসবের মাত্রিকতা যেমন ভিন্ন, সমাজ পরিবর্তনের আধুনিক পর্যায়ে এসে এই উৎসব এক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বিকশিত। মাহে রমজানের এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মুলে রয়েছে শাশ্বত বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দের যোগসূত্র যা ব্যক্তিকে মানবিকতায় ও নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ করে এক সুষম সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘হিন্দু-মুসলমান’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে “একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন : দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটাবে কে ?” নজরুল আরো বলেছেন “ন্যাজ যাদেরই গজায়- তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক- তারাই হয়ে ওঠে পশু। যে সব ন্যাজওয়ালা পশুর হিং¯্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে- শৃঙ্গরূপে, তাদের তত ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে- যাদের হিং¯্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি।”
নজরুলের উল্লেখিত হিং¯্রতাকে নিধন করার উপযোগী পন্থাই হচ্ছে মানবতার চর্চা। অন্যের কষ্টে ব্যথিত না হওয়া, অন্যের হৃদয়ের রক্তক্ষরণে নিজের হৃদয়ে বেদনার জন্ম না নেওয়া ইত্যকার অমানবিক, অশুভ ও অসংগতিপূর্ণ আচরণ সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাকে কতটুকু বিপর্যস্ত করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদ উৎসবের শিক্ষা এই মানবতাকে জাগ্রত করার জন্য কতবেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি নতুন করে বলার অবকাশ আছে বলে মনে হয়না। তবুও এখনো যখন ধর্মীয় উম্মাদনায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো নানা অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তখন দুঃখের সাথে নজরুলের উল্লেখিত বাণীগুলো বার বার স্মরণে আঘাত করে।
বস্তুতপক্ষে সামাজিক বিধিসমূহ প্রতিপালনের মাধ্যমে সমাজ-পরিবেশকে বাসযোগ্য করা এবং নানাবিধ সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করে মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠাই মানুষের ধর্মের মৌলিক উদ্দেশ্য। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ঘৃণা, সহানুভূতি ইত্যাদির ব্যক্তিগত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট মনোভাব সামাজিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ¯েœহ, প্রীতি, কৃতজ্ঞতা, ভদ্রতা এবং উপরোল্লেখিত বিষয়সমূহ সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। আতঙ্ক, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণা, ঔদ্ধতা, সন্দেহ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার পথে কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
পারস্পারিক মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা এবং আস্থা বৃদ্ধির পথ প্রশস্তকরণ দারুনভাবে ইতিবাচক সমাজ প্রতিষ্ঠার নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত। ঈদ উৎসব বা পূজা পার্বণে ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত, ধনী-গরীব নির্বিশেষে মানুষকে মানুষের মর্যদায় আসীন করার মধ্যেই প্রকৃত ধর্মের বাণী উচ্চারিত। বাঙালীর ঈদ উৎসব বা সকলকে নিয়ে আনন্দের ভাগাভাগিতে মেতে ওঠা, নাচ, গান, নাটক, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদির সমন্বয়ে এটিকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাঠামোতে না রেখে ধর্ম নিরেপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উপস্থাপিত হলেই এর মর্যাদা এবং তাৎপর্য অনেক বেশি মহিমান্বিত হবে-সেটিই স্বাভাবিক। এভাবেই মানব সমাজের বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুশাসন এবং অনুশীলণ সামাজিক সম্পর্কের গঠন ও অভিজ্ঞতাকে নতুন মাত্রিকতায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে আরোপ করে আসছে।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘সংস্কৃতি-কথা’ অনুসারে ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।’ এভাবেই ধর্মের বিশ্বজনীনতা মানবিকতাকেই গুরুত্বসহকারে গ্রহণের মাধ্যমে প্রত্যেক ধর্মের উৎসবগুলোয় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে আস্থা ও বিশ্বাসের পথকে সুপ্রশস্ত করার জন্যই অন্যান্য উৎসবের মত ঈদ উৎসব। এটিকে আরো অধিকতর উপভোগ্য করার লক্ষ্যে বঞ্চিত ও নিপিড়িত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সম্পৃক্ত করাই হোক অসাম্প্রদায়িকতার মানদ-।
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র এই তিনটি ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকাকে ব্যক্তির স্বাভাবিক ধর্মাশ্রয়ী মানসিক ও সামাজিক গঠন দ্বারা সীমাবদ্ধ না রেখে এটাকে অবারিত করে পার্থিব এবং অপার্থিব ভাবধারায় যেন মানুষের আবেগপ্রসূত কর্মকা-কে সকলের কল্যাণে একীভূত করা যায়, সে লক্ষ্যেই ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে পরিচালিত করাই হবে আধুনিক অসাম্প্রদায়িক ধর্মবিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি। ধর্মের অপব্যবহারকে সমাজ বা রাজনীতিতে নিরোধ করার লক্ষ্যে সকল শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মীয় ব্যবস্থাসহ ইত্যকার বিষয়সমূহকে গণতান্ত্রিক উদারনৈতিক আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ভাবধারায় প্রবাহমান করতে হবে। তা হলেই ঈদ উৎসব হবে সর্বজনীন সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। আর এটি হবে ঈদ উৎসবের মুখ্য সার্থকতা ও পরিপূর্ণতা। উক্ত নিবন্ধের কিছু অংশ আমার অন্য নিবন্ধে প্রকাশিত হলে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।

লেখক হ শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট