চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলা কবিতায় ঈদ

শাহিদ হাসান

৩ জুন, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

‘ঈদ-উল-ফিতর’ ও ‘ঈদ-উল-আজহা’ মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় ধর্মীয় দুটি উৎসব। দুটি উৎসবকে ঘিরে মুসলিম সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত ধনী-গরিব ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়ে এবং আর্থিক সাধ্যের মধ্যে থেকে ঈদ-আনন্দে শামিল হয়। অন্য ধর্মের লোকেরাও এ আনন্দ-উৎসবে অংশ গ্রহণ করে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষায় যুগে যুগে অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঈদ নিয়ে সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেন কবি সৈয়দ এমদাদ আলীর (১৮৮০-১৯৫৬) কবিতাগ্রন্থ ডালির দ্বিতীয় সংস্করণে (১৯৬৬) ‘ঈদ’ নামে দুটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রথমটির প্রথম পঙ্ক্তি ‘কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে’ এবং দ্বিতীয়টির প্রথম পঙ্ক্তি ‘বিশ্ব জুড়ে মুসলিমের গৃহে গৃহে আজি’।
১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত প্রথম বর্ষে কাবতাটি ‘নবনূর’-এর ঈদ-সংখ্যায় প্রকাশিত। কবিতাটি বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত ঈদ নিয়ে কবিতা। কবিতাটির প্রথম দুটি স্তবক আজকের পাঠকের জন্যে উদ্ধৃত করছি-
কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে
তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে
আজ কি হর্ষ ভরে।

আজি প্রভাতের মৃদুল বায়
রঙে নাচিয়া যেন কয়ে যায়
‘মুসলিম জাহান আজি একতায়
দেখ কত বল ধরে?
১৯০৩, ১৯০৪ ও ১৯০৫ সালে পরপর তিন বছর ‘নবনূর’ ঈদ-সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রত্যেক বছর এই পত্রিকায় ঈদ সংক্রান্ত কবিতাসহ অন্য লেখা প্রকাশ হতো। ‘নবনূর’ পত্রিকার প্রধান সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলী, কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১) এবং মিসেস আর, এস হোসেন অর্থাৎ বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২)। এ তিনজন ‘নবনূর’ পত্রিকায় ঈদ-সংক্রান্ত কবিতা বা গদ্য লিখেছেন। ‘নবনূর’- এর পৌষ ১৩১১ সংখ্যায় কায়কোবাদ লেখেন ‘ঈদ’ শীর্ষক কবিতা। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত (১৮৬৯-১৯২৭) ‘নবনূর’-এর ফাল্গুন ১৩১১ সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘ঈদজ্জোহা’ নামক প্রবন্ধ। ‘নবনূর’-এর পৌষ ১৩১২ সংখ্যায় এক সঙ্গে ঈদ-সম্পর্কিত তিনটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাগুলো হলো- সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতা, জীবেন্দু কুমার দত্তের ‘ঈদ সম্মিলন’ কবিতা এবং মিসেস আর এস হোসেন অর্থাৎ
বেগম রোকেয়ার ‘ঈদ সম্মিলন’ প্রবন্ধে ঈদের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার সঙ্গে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কথোপকথনের ভঙ্গিতে একটুখানি নতুন কথা যোগ করেছেন- ‘আর এক কথা। এমন শুভদিনে আমরা আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃবৃন্দকে ভুলিয়া থাকি কেন? ঈদের দিন হিন্দু ভাতৃগণ আমাদের সহিত সম্মিলিত হইবেন, এরূপ আশা কি দুরাশা? সমুদয় বঙ্গবাসী একই বঙ্গের সন্তান নহেন কী? অন্ধকার অমানিশার অবসানে যেমন তরুণ অরুণ আইসে, তদ্রƒপ আমাদের এখানে অভিশাপের পর এমন আশীর্বাদ আসুক, ভ্রাতৃবিরোধের স্থানে এখন পবিত্র একথা বিদ্যমান থাকুক। আমিন!’
‘ঈদ আবাহন’ একই নামে মহাকবি কায়কোবাদ দুটি কবিতা লিখেছিলেন। একটি তাঁর অশ্রুমালা (১৩১১) অন্যটি অমিয়ধারা (১৩২৯) কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। দুটি কবিতাতে ঈদ উপলক্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের সাম্যের কামনা করেছেন কায়কোবাদ এভাবে-
১.
আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মনঃপ্রাণ,
জাগায়ে মোশ্লেম সবে গাহ আজি মিলনের গান।
(ঈদ আবাহন : অশ্রুমালা)
২.
আজি এ ঈদের দিনে
এ পবিত্র শুভক্ষণে
এস ভাই এক সনে হৃদয় বাঁধিয়া।
(ঈদ-আবাহন : অমিয়ধারা)
মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩) ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭ বঙ্গাব্দে ‘ঈদ’ কবিতায় লিখেছেন-
মুসলেমের আজ ঈদ শুভময়
আজ মিলনের দিন,
গলায় গলায় মাখামাখি
আমির ফকির হীন।
শেখ ফজলল করিম (১৮৮২-১৯৩৬) ‘ঈদ’ কবিতায় লিখেছেন-
অলস অধম মোরা এখনো কি অবহেলে
যাব রসাতলে?
অদৃষ্টের উপহাস এখনো কি আনিবে না
চেতনা ফিরিয়া?
(বাসনা পত্রিকা : আশ্বিন ১৩১৫)
নজরুলের সম-সাময়িক শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩) ও গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) ঈদ বিষয়ক কবিতা লিখেছেন। শাহাদাৎ হোসেনের কবিতার বিষয়ে ও প্রকাশভঙ্গি তাঁর স্বভাব-সুলভ চিন্তন প্রক্রিয়ায় বিন্যাসিত। ‘ঈদুল ফিতর’ কবিতায়-
কোথা মক্কা-মোয়াজ্জেমা মদিনা কোথায়
প্রাণকেন্দ্র এ মহাসাম্যের
কোথা আমি ভারতের প্রান্ততটে ক্ষুদ্র ঈদগাহে।
কবি শাহাদাৎ হোসেনের কবিতাটি ১৯২৪ সালে রচিত। তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন চলছিলো এ উপমহাদেশে। এসময় মুসলিম সম্প্রদায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকসহ সর্বক্ষেত্রে নানা কারণে পিছিয়ে ছিলো। ব্রিটিশ ও কতিপয় উঁচু বর্ণে বিলাসী হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং আত্ম-পরিচয় সমুজ্জ্বল করার জন্যে কবি উচ্চারণ করেছেন-‘সাম্যের দিশারী আমি-আমি মুসলমান’।
কবি গোলাম মোস্তফা ঈদুল আজহার বর্ণনা কাহিনিধর্মী। ‘কোরবানি’ নামে খোশরোজ ও কাব্যকাহিনি গ্রন্থভুক্ত কবির দুটি কবিতা এর সাক্ষ্য দেবে। গোলাম মোস্তফার ‘ঈদ-উৎসব’ কবিতাটি (প্রথম প্রকাশ: ‘সওগাত’, ভাদ্র ১৩২৬) গীতলধারায় রচিত। স্তবকটি এরকম-
সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা সুরভি লভিয়াছে হর্ষে
আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়াছে, রাখিতে হবে সারা বর্ষে,
এ ঈদ হোক আজি সফল ধন্য
নিখিল-মানবের মিলন জন্য,
শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশিস স্পর্শে।
আজ দিবালোকের মতো সত্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ইসলামের নানা বিষয় বাংলা সাহিত্যে নবরূপায়ণ করেন। এসাফল্যের কারণগুলো হচ্ছে- তাঁর বিষয়, বক্তব্য ও বিন্যাসের সমন্বয়ে সুদৃঢ় বন্ধন। ১৯২৭ সালে নজরুল ইসলাম প্রথম সাহস করে উচ্চারণ করেছিলেন ‘আমি মনে করি, বিশ্ব-কাব্যলক্ষ্মীর একটি মুসলমানী ঢং আছে।’ এই ‘মুসলমানী ঢং’ রবীন্দ্রযুগে একমাত্র নজরুলই বাংলা সাহিত্যে নব-জোয়ার এনেছিলেন। এই ‘মুসলমানী ঢং’ সৃষ্টিতে নজরুলের অন্যতম অবলম্বন আরবি-ফরাসি শব্দ সময়োপযোগী ব্যবহার। নজরুলের ঈদুল ফিতরের কবিতায়-গানে বারবার এসেছে দরিদ্রের জন্যে তাঁর মমত্বময় সংবেদন-
জাকাত লইতে আসমানে এলো আবার ডাকাত চাঁদ
গরীব কাঙাল হাত পাত, ধনী রইস সবাই বাঁধ।
(জাকাত লইতে এসেছে…)
(ঈদের চাঁদ)
বেগম সুফিয়া কামাল বছর-বছর ঈদের কবিতা লিখে গেছেন। তাঁর ‘ঈদ’ কবিতার প্রথম চার পঙক্তি-
কত উৎসুক মানব মনের শান্তি কামনা লয়ে,
দ্বিতীয়ার চাঁদ অস্ত গগনে পাবক প্রতীক হয়ে।
আশরাফ আলী খান চিরকালই ছিলেন নির্জিতদের পক্ষে, ‘ঈদ’ কবিতাতেও তাঁর মানসগঠনের পরিচয় পাওয়া যায়। কবিতার সর্বশষ স্তবকটি হলো-
সাঁঝের আকাশে দেখা দেয় চাঁদ, ঘরে ঘরে লাগে ধুম,
সারা রাত ধরি চলে উৎসব, কারো চোখে নাই ঘুম।
ফররুখ আহমদ তাঁর ‘ঈদের স্বপ্ন’ সনেটে গোত্রের কবিতায় ঈদের চাঁদ কীভাবে আকাশে উদিত হলো তার বর্ণনা অষ্টকের প্রথম চার পঙক্তি এরকম-
আকাশের বাঁক ঘুরে চাঁদ এলো ছবির মতন,
নতুন কিশতি বুঝি এলো ঘুরে অজানা সাগর
নাবিকের শ্রান্ত মনে পৃথিবী কি পাঠালো খবর
আজ এ স্বপ্নের মাঠে রাঙা মেঘ হলো ঘন বন!
ঈদের নতুন চাঁদ সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে না। গরিব-দুঃখিদের দুঃখ-কষ্ট দূর হয় না। তাদের মনের আকুলতা ফুটে উঠেছে কবি তালিম হোসেনের ‘ঈদের ফরিয়াদ’ কবিতায়-
ঈদ মোবারক, সালাম বন্ধু, আজি এই খুশরোজে
দাওয়াত কবুল করো মানুষের বেদনার মহাভোজে
কহিবো কি আর, চির-মানুষের ওগো বেদনার সাথী,
ঈদ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সবার মাঝে নব উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ঈদ এলে সমাজে যে আনন্দ-লহরি বয়ে যায়, তা ফুটিয়ে তুলেছেন কবি আ.ন.ম বজলুর রশিদ তার ‘ঈদ আসে’ কবিতায়-
ঈদ আসে হাসি-খুশি
তোমাদের আমাদের সকলের ঘরে অনেক আনন্দ নিয়ে
কিছুক্ষণ ভুলে যাই দুঃখ জ্বালা যত
আজ শুধু মেলামেশা অন্তরঙ্গ হয়ে থাকা
অবিরত আল্লাহর প্রশংসায় গান
তার দয়া দাক্ষিণ্যের অমৃত ঝরে।
কবি সৈয়দ আলী আহসান ঈদের চাঁদে যেনো দেখেছেন নতুন দিনের বার্তা। তার ‘নতুন দিনের বার্তা’ কবিতায় লিখেছেন-
এসেছে নতুন দিন
আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে, কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ
জরির জোব্বা শেরওয়ানী আর আমামার সজ্জায়
আতরের পানি মেশকের রেনু খুশবু বিলায়ে যায়
বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি, ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর
সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে রাত্রি হয়েছে ভোর।
কবি সিকান্দার আবু জাফর দোয়া চেয়ে পিতার কাছে ‘ঈদের চিঠি’তে লিখেছেন-
ঈদের সালাম নিও, দোয়া করো
আগামী বছর কাটিয়ে উঠতে পারি যেন
এই তিক্ত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা। অন্তত
শত বছর ধরে ঈদকে কেন্দ্র করে কবিতা-গান রচিত হয়েছে। এখানে উল্লেখিত ঈদ নিয়ে কবিতাগুলো রোমান্টিক ভাবধারায় আনন্দ-উৎসবের বয়ান। উক্ত কবিতাগুলো পাঠ করলে সহজে অনুমান করা যায় দেশে জনসাধারণের মনে ঈদের আনন্দ-জোয়ার। মূলত তা নয়। নজরুল এবং তালিম হোসেন এদিক থেকে ব্যতিক্রম। তাঁরা দুজনে তাঁদের নিজ-নিজ সময়কে চিহ্নিত করছেন। ঈদের দিন অসহায় মানুষের মনোবেদনা তাঁদের কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে রূপায়িত হয়েছে। আজকের ঈদেও তাঁদের কবিতা প্রাসঙ্গিক।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিনে ঈদ কিছুটা সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। যখন ঈদ সাংস্কৃতিক স্তরে রূপান্তরিত হয় তখন অসাম্প্রদায়িক চেতনাটি সবল হয়ে ওঠে। ঈদের সাংস্কৃতিক উৎসবে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারে। অথচ এ ধরনের আনন্দ-উদ্যাপন ধর্মান্ধরা মনে-প্রাণে চায় না। বেগম রোকেয়া চিন্তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলতে পারি, আমরা সকলে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। ১৯৭১ সালে সব ধর্মের লোকেরা দেশ স্বাধীন করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধ অংশ গ্রহণ করেছে। আমরা সকলে এ দেশের জলবায়ুতে বসবাস করছি। সকল সম্প্রদায়ের সদস্যরা নির্বিঘেœ ঈদের সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ গ্রহণ করতে পারলে দেশের সংস্কৃতিতে অনন্যমাত্রা যোগ হবে। তাই বাংলা কবিতায় ঈদের সাম্য, মানবতা ও ত্যাগের মহিমা অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার মাধ্যমে জাগ্রত করা এ মুহূর্তে অতীব জরুরি। তা হলে ঈদের মর্মবাণী সার্থক ও সুন্দর হবে। এ দায়িত্ব প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের।

লেখক হ কবি ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট