চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিশুদের শুদ্ধ ভাষা শিক্ষায় শিক্ষকদের করণীয়

রমিতা ইসলাম

২০ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:০৯ পূর্বাহ্ণ

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক স্তর। কারণ প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার প্রথম সোপান। এ স্তরেই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ভিত রচিত হয়। এ স্তরে শিক্ষার্থী যা শিখবে, যেভাবে শিখবে তারই প্রতিফলন সে তার ভবিষ্যৎ জীবনে ঘটাবে। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশই প্রাথমিক শিক্ষা স্তরকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে। এ স্তরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হবে, পাঠ্যপুস্তক কেমন হবে, পাঠ্যপুস্তকে কী থাকবে, শিক্ষকের যোগ্যতা কী হবে, শিক্ষার্থী কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করবে, ইত্যাদি সবই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নির্ধারিত হয়।

একটি দেশের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করার অন্যতম একটি উপায় হলো শিক্ষা। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর তাই শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম স্তর প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৯০ সালে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে।

সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পটভূমিতে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য এই স্তরের শিক্ষা শেষে শিশুর কতটা জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে বলে আমরা আশা করি, তা সুনির্দিষ্ট হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিশুর শিক্ষা শুধু তার বর্তমান চাহিদা মেটাবার জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ জীবনে সে যেন একজন সক্ষম সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে সেজন্য তাকে গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমান যুগে দ্রুতগতিতে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবনধারার পরিবর্তন হচ্ছে। তাই আজকের দিনের শিশুকে এমন যোগ্যতা ও সামর্থ্য অর্জন করতে হবে যেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সে একজন সার্থক মানুষ এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে জীবনযাপন করতে পারে। এ সামর্থ্য অর্জন নিশ্চিত করার জন্য তাই অনাবশ্যক তত্ত্ব ও তথ্য শেখার পরিবর্তে একান্ত আবশ্যকীয় কতগুলো যোগ্যতা অর্জনে শিশুকে সহায়তা করতে হবে।
শিখন-শেখানো পদ্ধতির মধ্য দিয়ে কোনো জ্ঞান, দক্ষতা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে তার একটি যোগ্যতা বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা বিষয়ের পঠন-পাঠনের মাধ্যমে শুদ্ধভাবে ও স্পষ্ট স্বরে কথা বলতে পারার দক্ষতা আয়ত্ত করার পর শিশু যদি তার পারিবারিক বা সামাজিক পরিবেশে শুদ্ধ ভাষায় ও স্পষ্ট স্বরে কথা বলতে পারে তবে সেটি তার যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। এভাবে পাঁচ বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শিশুরা যে যোগ্যতাগুলো অর্জন করবে বলে আশা করা যায়, সেগুলোকে বলা হয় প্রাথমিক শিক্ষার প্রান্তিক যোগ্যতা।

প্রাথমিক শিক্ষা চক্র সমাপ্ত করার জন্য যেমন শিশুকে বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, তেমনি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তার আচার-আচরণ, কথা বলায় কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শুদ্ধভাবে আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষা। আর এই শিক্ষা প্রাথমিক স্তরেই যেহেতু অর্জন করতে হবে, সেহেতু আমরা বলতে পারি এক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিশুদের শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা শিক্ষায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রয়েছে নানা দায়িত্ব।
প্রথমত, শিক্ষকদের নিজেদের শুদ্ধভাবে কথা বলার চর্চা করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। আর এই আঞ্চলিকতার ভিড়ে শিশুরা সঠিক উচ্চারণটি শিখে নিতে মোটামুটি হিমশিম খায়। বাংলা ভাষায় সঠিক উচ্চারণ করতে হলে শিক্ষকদের নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করার ও
রেডিও-টিভিতে সংবাদ পাঠ শোনার অভ্যাস করতে হবে। তবেই একজন শিক্ষক নিজে শুদ্ধ বাংলা শিখে শিশুদের তা চর্চা করাতে পারবে।
শিক্ষকরা যখন একে অন্যের সাথে কথা বলেন, তখনও তাদের শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা দরকার। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। তারা শিক্ষকদের ক্লাসরুমের বাইরেও অনুকরণ করে থাকে।

শিশুদের নিয়মিত পাঠক্রমের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে শুদ্ধ বাংলা ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
বিদ্যালয়ে সপ্তাহে একদিন সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিশুদের কবিতা আবৃত্তি, গল্প পড়া ও বলা, গান ইত্যাদি অনুশীলন করাতে হবে। প্রতিদিন বাংলা বই থেকে হাতের লেখা লিখতে দিতে হবে এবং বাংলা পঠনের ওপর জোর দিতে হবে। শিশুদের গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে একদিন অন্তত উপস্থিত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। শিশুরা যতক্ষণ বিদ্যালয়ে অবস্থান করবে, ততক্ষণ তাদের একে অন্যের সাথে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলার চর্চা করাতে হবে। যেসব বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রয়েছে, সেসব বিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে শিশুতোষ অনুষ্ঠান, সিনেমা ইত্যাদি দেখার ব্যবস্থা করতে হবে।

জাতীয় বিশেষ দিবস উদযাপন উপলক্ষে বিদ্যালয়গুলো নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে শিশুদের বাংলা বানান, রচনা, কবিতা লেখা, গল্প বলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। বিষয়ভিত্তিক দেয়ালিকা প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। সাবলীলভাবে পঠনের যোগ্যতা বাড়াতে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের সংবাদপত্র সংগ্রহ করতে হবে তা নয়। পুরাতন সংবাদপত্র সংগ্রহ করে পড়ানো যেতে পারে।
এসব নানা ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনায়াসেই শিশুদের শুদ্ধ বাংলা শিক্ষা দিতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকাও কম নয়। প্রাথমিক ও

গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব মহোদয় মো. আকরাম আল হোসেন শিশুদের
সাবলীলভাবে পঠন ও লিখন যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য নয়টি নির্দেশনা সম্বলিত পরিপত্র জারি করেছেন, যা অনুসরণ করে শিক্ষকরা সহজেই শিক্ষার্থীদের অনুশীলন করাতে পারেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষামূলক নানা ধরনের বই প্রদান করা হচ্ছে যেগুলো পড়ে শিশুরা শুদ্ধ বাংলা সহজেই আয়ত্ব করতে পারে।
প্রতিটি বিদ্যালয়েই রয়েছে বুক কর্ণার। তবে এবিষয়ে শিক্ষকদের থাকতে হবে ইতিবাচক মনমানসিকতা ও আন্তরিকতা। অতএব আমরা বলতে পারি শিশুদের যেটুকু শেখানো দরকার, সেটুকু শেখানোই ভালো। তার সঙ্গে একটু জায়গা থাকা দরকার, যেখানে আনন্দের আলো প্রবেশ করতে পারে। আর এই আনন্দের সাথে শিখেই শিশুরা রচনা করবে ভবিষ্যতের ভিত। আমরা এগিয়ে যাবো ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ একটি স্বপ্নের বাংলাদেশের দিকে।

শেয়ার করুন