চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার

২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ১:১৩ পূর্বাহ্ণ

আমাদের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতি প্রতিযোগিতা বাড়াতে বলছি। সাহিত্য
সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নিজেকে অন্যের নিকট তুলে ধরতে পারে। মানুষ তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখনুভূতি অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চায়, এতে সে তৃপ্ত হয় এ তৃপ্তির মধ্যেই তার পরম আনন্দ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অব্যাহত সাহিত্য চর্চা আমাদের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মন, বস্তুজগৎ ও প্রকাশ ভঙ্গিকে শানিত করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। শিক্ষালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা দলবদ্ধভাবে একত্রিত হয়। ছাত্র জীবন আনন্দের কূপক্ষেত্র। আনন্দকে বাদ দিয়ে শিক্ষার স্বার্থকতা নেই। কাজেই জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের সংযোগ যেমন শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের সম্পর্কও তেমনি। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য সত্য ও সুন্দরের প্রকাশ ঘটানোর জন্য, দেশ ও জাতিকে কল্যাণের পথে এগিয়ে দিতে সর্বোপরি, নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে যেভাবে সম্ভব তা অন্যভাবে সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড়কথা হল, শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চা একই সাথে চলতে পারে।

সংস্কৃতি হলো সার্বিক জীবন প্রণালী। একজন মানুষ যা করে তাই তার সংস্কৃতি। আমরা বাঙালি। বাংলাদেশি। আমাদের নিজস্ব সংষ্কৃতি আছে। আমরা সাহিত্য ও সংস্কৃতিবোধ সমৃদ্ধ জাতি। এদেশের মানুষের হাজার বছরের চলে আসা সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল ও মার্জিত চিত্রই আমাদের সাহিত্য ও সংষ্কৃতির অলঙ্কার। একথা মানতেই হবে যে, এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে থাকা সংষ্কৃতি পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশের চেয়ে মার্জিত ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য। যা’ আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের পবিত্র ও উন্নত চরিত্র গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে।
আমি বহুবার বলেছি যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানবজাতির অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। শিক্ষার জন্য সুস্থ শরীর ও মন অপরিহার্য। অথচ দেহের সঙ্গে মনের সংযোগ অত্যন্ত নিবিড়। দেহকে সতেজ না রাখলে মন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর দেহ, মন ও উন্নত শিক্ষার জন্য খেলাধুলা ও সাহিত্য চর্চা দরকার। যা আনন্দময় শিক্ষার জন্য অপরিহার্য।

মানুষের জীবনের সতেজ সময় ছাত্রজীবন। এ সময় থেকেই জীবন গড়ার প্রস্তুতি চলে। শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে তাদের খেলাধুলা করা উচিত। আবারও বলছি, শরীর ও মনকে বিকশিত করে তোলাই
লেখাপড়ার উদ্দেশ্য। তাই, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় মনোযোগী হওয়া দরকার। এবং তা’ অবশ্যই এদেশীয় হওয়া চাই। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে এমন সব সাহিত্য চর্চা ও খেলাধুলা আছে যেগুলোতে আর্থিক সংশ্লিষ্ট নাই। জারি-সারি, ভাটিয়ালী, কবিতা পাঠ, হামদ-নাত, নাটক-নাটিকা, গল্প বলা, কৌতুক উপস্থাপন, নাচ, গান, দেশীয় পালাগান, কবিগান, আখড়াইগান, পুঁথিপাঠ এর সাথে সাথে লাঠি খেলা, বৌচি, দাড়িয়াবান্দা লুডু খেলা, হা ডু ডু গোল্লাছুট, ডানগুলি, সাপখেলা, কানামাছি, বলি খেলা, কেরাম, দাবা, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড় দৌড়, নৌকা বাইচ, লাটিম, মার্বেল, পাতার বাঁশি, বাঁশের বাঁশি, শিস দেয়া, হাততালি,
চি-কুতকুত খেলা, লুডু খেলা ইত্যাদি এমন বহু

খেলাধুলা যেমন লুকোচুরি খেলা, সাঁতারকাটা মত খেলায় তেমন টাকা-পয়সা খরচ হয় না অথচ এসবে আনন্দ আর আনন্দ। এসব খেলাধুলা ও সাহিত্য চর্চা সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল, মার্জিত যা পরিবার ও শিক্ষালয়ে অনায়াসে করা যায়। প্রতিটি শিক্ষালয়ে বাংলার আবহমান ধরে লালিত এসব দেশীয় খেলাধুলা ও সাহিত্য চর্চার ব্যবস্থা থাকা চাই। কারণ, এসব আমাদের সরল প্রাণের জীবন্ত উৎস। শিক্ষালয় ভিত্তিক অপসংস্কৃতি মহামারি রূপ ধারণ করার আগেই প্রত্যেকটি শিক্ষালয়ে ক্রীড়া ও সাহিত্য শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। ১ জন ক্রীড়া শিক্ষক, ১ জন গানের শিক্ষক এবং ১ জন চারুকলা শিক্ষক এ ৩বিষয়ে ন্যূনতম ১জন করে শিক্ষক সহসা নিয়োগ করার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আকুল আবেদন জানাই এবং সে সাথে বার্ষিক ক্রীড়া সাহিত্য ও সাংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি তথা এদেশীয় সংষ্কৃতি যুক্ত করত বিদেশীয় সংস্কৃতিযুক্ত

অপসংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করার প্রয়াস আজই নেয়া উচিত। কারণ, পাশ্চাত্য সংষ্কৃতির প্রভাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে ছাত্র সমাজ ভুলতে বসেছে আমাদের ঐতিহ্য দেশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি। নবীন বরণ ও বিদায়ী অনুষ্ঠানে বর্তমানে আমন্ত্রিক শিল্পী ও ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের দেশীয় বাংলা গানের পরিবর্তে হিন্দি, মেটালিক পপ ও ইংরেজি গানের ঝংকার তোলেন। আচার-আচরণ ও এভাবে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে আমরা দেশজ রীতিনীতি ও মূল্যবোধ কে বিসর্জন দিতে শুরু করেছি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এভাবে পাশ্চাত্য লাইফ স্টাইলের প্রভাবে আমাদের তরুণ-তরুণীরা বিশেষ করে

ছাত্র-ছাত্রীরা দেশীয় কালচারের সাথে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়াও অতি শিক্ষা, পরীক্ষাভীতি, শিক্ষা মানের ক্রমাবনতি, সাংসারিক টানাপড়েন, দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, কর্মব্যস্ততা ইত্যাদি দেশের মানুষ শুদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় বিমুখ হয়ে উঠছেন।
সংস্কৃতি বাতাসের মত বহমান। এটি পারস্পরিক

বিনিময় যোগ্য ও অনুকরণীয়। এটি কোথাও চিরদিন স্থির থাকে না। গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে দিয়ে এটি বেঁচে থাকে- এটিই স্বাভাবিক। আমাদের উদ্বেগের কারণ হলো- নতুনত্ব গ্রহণের মাধ্যমে যদি আমরা নিজেদের স্বকিয়তা হারিয়ে ফেলি, অব্যাহত আগ্রাসনের শিকার হই। বলা বাহুল্য যে, দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষালয় সাংস্কৃতি আগ্রাসনের শিকার- এটা সহজেই অনুমেয়। নিজের মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও দেশীয় সংস্কৃতির অব্যাহত চর্চার মাধ্যমেই দেশের শিক্ষালয়গুলোকে জিঁইয়ে রাখা দরকার। তবেই আমরা সুন্দরের পথে, কল্যাণের পথে এগিয়ে যেতে পারবো।

আধুনিক ও প্রযুক্তিগত সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে নয় বরং কাজে লাগিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত সব সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া এবং ধর্ম ও নৈতিক কর্মকা-ে সর্বাগ্রে বাঙালি তথা বাংলাদেশী সংস্কৃতি প্রচলন জোরদার করা উচিত। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এদেশে এমন বহু খেলাধুলা, সংগীত আছে যেসব চর্চায় আর্থিক সামর্থ্য লাগে না। লুকোচুরি, মিউজিক্যাল চেয়ার, দৌড় প্রতিযোগিতা, সাঁতার কাটা, গোল্লাছুট, পুকুরে হাঁস ধরা, কুতকুত খেলা, বরফপানি বা শরীর ছোঁড়া খেলায় মোটেও টাকা পয়সা লাগে না- অথচ, এসব খেলায় অপার আনন্দ। সংগীত, হাম-নাত, কবিতা রচনা, কবিতা পাঠ, গল্প বলা, কৌতুক করা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও তাই। সুতরাং শিক্ষা ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে শিক্ষালয়ে দেশীয় সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানোর জন্য আমাদের বিনীত আবেদন রইল।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট