চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ব্যর্থতাকে ভয় পাওয়া চলবে না

ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন

১৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘদিন ভেবেছি যে আজ শিক্ষার্থীদের কি বললে তারা উপকৃত হবে । মনে অনেক ধরনের আবেগ, আনন্দ, প্রতিক্ষা, উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। আমি যখন প্রথম প্রাইমারী স্কুলে যাই ঠিক সেই রকম অবস্থা। আমরা সবাই উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য পা বাড়াই, পেশাগত উন্নতি বিধান করার জন্য যাই-একস্থান থেকে অন্য স্থানে। কিন্তু সকলের মনে রাখা দরকার যে শিক্ষা গ্রহণ এখানে শেষ নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা গ্রহণের কেন্দ্র। তাই জীবন যুদ্ধ হতে যত পারি সকলের শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরী। শিক্ষক হয়ে প্রথম অবস্থায় আমি সব সময় হতাশার মধ্যে থাকতাম। এক সময় ভাবতে লাগলাম জীবনের কোন পেশাই ছোট নয়-যদি সেই পেশাকে জীবনের সাথে এক করে নেয় যায়। সত্যি কথা বলতে কি ! এক সময় মনে হতো সব ছেড়ে চলে যাই। এখন আমি সার্থক। শিক্ষকতার জন্য আমি পেয়েছি নতুন জীবন। শিক্ষক হতে পেরেছি বা চেষ্টা করার সুযোগ সৃষ্টিকর্তা করে দিয়েছেন বলে তাকে ধন্যবাদ জানাই।

আমরা অনেকে হয়তো ঠিক করে ফেলেছি জীবনে কি করবো। অনেকে এইক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছি, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। কিন্তু এই বিষয়টি ঠিক নয়, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ভয়, লজ্জাকে প্রতিহত করতে হবে-সামনের দিকে তাকাতে হবে। সাধনা করতে হবে বার বার। যেখানে পরাজিত হবো সেখান থেকে কার্যক্রম শুরু হবে। মনে রাখতে হবে শেষ বলে কিছু নেই। আপনাদের বলছি জীবনটা একটা ম্যারাথন, জীবনের গতি আপনাকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেন জীবনের গতি পরিবর্তন করতে পারবেন। তাই জীবনের মানচিত্র তৈরী করবেন, কিন্তু তা করবেন পেন্সিল দিয়ে। যাতে মুছে আবার নতুন কোন শব্দ বসানো যায়। আর ব্যর্থতা নিয়ে বলতে চাই-ব্যর্থতা হল মানুষের দারুণ প্রতিপক্ষ। তাই বলে কারো উচিত নয় ব্যর্থতাকে ভয় পাওয়া। বরং এটাই শিখাবে, শিক্ষা দিবে-নিজের ও অন্যের অনেক কিছু। অনেক কাজে আমরা অনেকে বিফল হই-কিন্তু তা থেকে শিখতে হবে।

প্রত্যেক মানুষ কতগুলো সহজাত গুণাবলী নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিখনের মাধ্যমে এসব গুণাবলী বিকশিত হয়। শিক্ষা সেই গুণাবলীকে পরিশুদ্ধ করে, বেড়ে তোলে। তবে কোন কোন গুণাবলী বিকশিত হবে, আর কোন কোন গুণাবলী বিকশিত হবে না তা নির্ভর করে ব্যক্তি পরিবর্তনের উপর। তবে কতটুকু পরিবর্তন হবে তা বলা আসলে মুশকিল। সেই কারণে দরকার জীবনের শুরু হবে ব্যক্তিত্ব বিকাশে এগিয়ে যাওয়া। ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন না হলে মানুষের জীবনের আর কোন পরিবর্তন আসলে অসম্ভব। তাই ব্যক্তিত্বের একটি বড় উপাদান হলো স্নায়ুতন্ত্র, মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে কোন সমস্যা থাকলে তা ব্যক্তিত্বের উপর দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ব্যক্তির শাররীক গঠনও ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। খাদ্যাভাসের কারণেও মানুষ রগ্নশীল মানুষে পরিণত হতে পারে এবং এতে করে ব্যক্তিত্ব বিকশিত ও পরিণত হতে পারে। তাই খাদ্যাভাস, কথা ও চালচলনে সকলকে মার্জিত ও সাধনা স্বরূপ হতে হবে আর এতে করে মানুষ তার লক্ষ্য স্থলে পৌঁছে যেতে সক্ষম হবে।

শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও আদর্শ ভ্রান্তির পথে ধাবমান। প্রতিহিংসা আজ চরমে, আত্ন-বিশ্বাসও বিপর্যস্থ। এমতাবস্থায় নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে। আর এক্ষেত্রে পরিবারের পরে শিক্ষকদের সচেতনতা যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন নৈতিক শিক্ষায় সুদক্ষ মানুষই কেবল পারে একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে। এক্ষেত্রে উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ হিসাবে নিজেকে উপস্থান অনেকটা জরুরী। সুদক্ষ সুশিক্ষিত শিক্ষক এবং উপযুক্ত পরিবেশে শিশুরা নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হয়। যদি বদ্ধ জলাশয়ের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয় আর জ্ঞানের সচল প্রবাহ না থাকে, থাকে শুধু স্তব্ধতা তবে তেমন জলাশয় না থাকাই বাঞ্ছনীয়। যেহেতু শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি ছাত্র, সেক্ষেত্রে শিক্ষককে হতে হবে সৃষ্টিশীল, আদর্শবান ও উদ্দ্যোমী। যদিও এ যুগে নীতিকথা মূল্যহীন তথাপি নৈতিকতা বর্হিভূত শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের কোন উপকারে আসে না। বাস্তবতার নিষ্পেষনে বিবেককে বিসর্জন দেয়া কাপুরুষের লক্ষণ ছাড়া আর কি হতে পারে? তাই জীবন যদ্ধে জয়ী হওয়ার আর একটি ধাপ হল নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ।

জীবন যুদ্ধে সফল হতে হলে প্রয়োজন নিজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। বিশ্বাস করতে হবে-বিখ্যাত হওয়ার জন্য আপনিও একজন। বিশ্বাস করতে হবে ভালবাসায়, কাজে, সাধনায় ও ধর্মে। তাহলে সকল কাজই আপনার জীবনের জন্য সার্থকতা এনে দিবে। নিজেকে স্বতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে হবে, আত্ন নিয়োগ করতে হবে দায়িত্বের প্রতি। আমাদের অনেকের মধ্যে যা কিছু আছে অন্য অনেকের মধ্যে তা নেই। এই বিশ্বাস সকলের থাকতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না, মনে রাখতে হবে আজকের দিনটি আপনার জীবনের শেষ দিন। ভাল যা তা করতে থাকুন, কারণ তাতে আপনার মন সাড়া দেয়ার মত অবস্থা তৈরী হয়েছে। বড় হবেন, বৃদ্ধ হওয়া চলবে না। অলৌকিক ঘটনা প্রতিদিন অনেক হয়, ঘটনা গুলোর সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে হবে। যতক্ষন জীবিত থাকবেন ততক্ষণ এইসব ঘটনা ঘটতে থাকবে।

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা অতীতের অনেক গুলো দু.খ কষ্টের ঘটনা নিয়ে জীবন যুদ্ধে হতাশায় থাকেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। জীবনে অনেক দু.খ, কষ্ট হতাশা বেদনা থাকবে। আর এইসবের সমষ্টি হল জীবন। এভাবে বেড়ে চলতে হবে, বিজয়ী হতে হবে। স্থিতিস্থাপকতা মানব জীবনের একটি বিশেষরূপ। এসবের প্রভাবেই মানুষ অতীতকে ভুলতে পারে, চেতনায় দু.খ কষ্টকে রেখে নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারে। স্থিতিস্থাপকতা আনয়নে ব্যক্তি মনের প্রভাব এবং মানসিক চেতনা অনেক বেশি প্রয়োজন হয়। কারণ মনের জোর না থাকলে অতি দ্রুত ব্যক্তি স্বাভাবিক অবস্থা বা স্থিতিস্থাপকতায় আসতে পারে না। প্রতিটি জীবনে দু.খ কষ্ট, বেদনা, হতাশা ও বিপদ আসে। এতে নানা মানসিক চাপ মানুষকে সইতে হয়। কিন্তু তাই বলে তহাশ হওয়া চলবে না। এই ধরণের মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য দরকার-
ক. মানসিক উচ্চাকাঙ্খা,
খ. অর্থপূর্ণ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করা,
গ. ইতিবাচক অঙ্গিকার করা,
ঘ. স্পষ্ট ও সঙ্গতিপূর্ণ কাজে এগিয়ে আসা,
ঙ. জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
এইসব গুণাবলী মানুষকে মানুষে পরিণত করতে সাহায্য করে। একজন আধুনিক যুগের নাগরিক হিসাবে আপনার জীবনকে অর্থবহ করতে চাই দৃঢতার সাথে সুন্দর কাজ গুলোতে নিজেকে জড়িত রাখা। কোন সমস্যায়, সংকটকালে বা কষ্টজনিত কারণে আপনাকে অবশ্যই একাগ্রচিত্তে এগিয়ে যেতে হবে।

আমরা আগামী নিয়ে ভাবতে পারি না। আমাদের পেছনে অতীত ঘুরতে থাকে, এখনও এমন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকজন নিজেকে বাঙালী পরিচয় না দিতে পারলে বরং বাঁচে। শিক্ষা ও শিক্ষানীতির এই চিত্র সুদুর কাল থেকে চলে আসছে। জাতি হিসসাবে এটা আমাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিপদেরও বটে। আর এই বিপদ গুলো জীবনকে করে তুলেচে অনিরাপদ। এমন পরিস্থিতির সংজ্ঞাকে কেউ রোধ করতে পারছে না। যারফলে বিশ্বকবি রবি ঠাকুর হতাশ চিত্রে মন্তব্য করেছিলেন এভাবে, ‘একজন দরিদ্র সমস্ত শীতকালে অল্প ভিক্ষা সঞ্চয় করিয়া যখন শীতবস্ত্র কিনিতে সক্ষম হইত তখন গ্রীস্ম আসিয়া পড়িত, আবার সমস্ত গ্রীস্মকাল চেষ্টা করিয়া যখন লঘুবস্ত্র লাভ করিত তখন অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি, দেবতা যখন তাহার দৈন্য দেখিয়া দয়ার্দ্র হইয়া বর দিতে চাহিলেন তখন সে কহিল, আমি আর কিছু চাহি না, আমার এই হেরফের ঘুচাইয়া দাও।’
আমাদের জাতীয় শিক্ষা ও শিক্ষানীতির এমন অবস্থা দেখে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন এভাবে,
‘পরের সব ভাল-মন্দকে ভাল বলিয়া মানিয়া লওয়ার, আত্বন, নিজের শক্তি ও জাতীয় সত্যকে নেহাৎ খর্ব করা হয়। নিজের শক্তি, স্বজাতির বিশেষত্ব হারানো মনুষ্যত্বের মস্ত অবমাননা। স্বদেশের মাঝেই বিশ্বকে পাইতে হবে। সীমার মাঝেই অসীমের সুর বাজাইতে হইবে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দেশের মানুষের মাঝে প্রকৃতি ও তাদের সত্বা সর্ম্পকে বলতে গিয়ে বলেছেন এভাবে,
‘আমাদের পানিও আছে পিয়াসও আছে, দেখিয়া পৃথিবীর লোক হাসিতেছে এবং আমাদের চক্ষে অশ্রু আসিতেছে, কেবল আমরা পান করিতে পরিতেছি না।’

তাই পানি পান করার অদম্য সাহস আমাদের মধ্যে আসতে হবে, আগামীর স্বপ্ন আমাদের দেখতে হবে। জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। আর এই কর্মকান্ড গুলো অলৌকিকভাবে হবে না, করতে হবে আপনাকে, আমাকে ও আমাদের সকলকে। নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে একজন সাহসী মানুষ হিসাবে। এটা চাইলে আমরা সকলেই পারি, আমাদের নিজের জন্য আমাদের তা করতে হবে, আমরা তা করব। কারণ আমি কাজের মাধ্যমে অনেক বড় হতে চাই-বয়সের মাধ্যমে নয়। বয়স কাউকে ছোট বড় করে না বরং কর্ম মানুষকে ছোট বড় করে তোলে। জীবনের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাওয়ার জন্য দরকার জীবনের গতি পথকে অর্থপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা। বয়সের কারণে বৃদ্ধ হতে হবে এটা প্রাকৃতিক। আর কর্মের মাধ্যমে সমাজে বেঁচে থাকতে হবে অনন্তকাল, আমরাও কর্মের মাধ্যমে পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাই, আমরাও পারি।

লেখক : গবেষক ও শিক্ষাবিদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট