চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : প্রত্যাশা ও করণীয়

শর্মী দাশ

৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:২৭ পূর্বাহ্ণ

একজন শিক্ষক জাতির প্রথ-প্রদর্শক। জাতির চালিকা শক্তি ঠিক রাখার জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা অপরসীম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয় শিক্ষককে। শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের কাছে বাবা-মায়ের মতো। বাবা-মা যেমন তাদের ভালোবাসা-স্নেহ-মমতা দিয়ে সন্তানদের বড় করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকেরা শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। এর সাথে থাকে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা। তাঁদের শিক্ষার আলো যেমনি শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস :

গেল ৫ অক্টোবর সারাবিশ্বের শিক্ষকদের সম্মানে

গৃহীত হয়, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। সব দেশের মত বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে- জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শিক্ষকদের মর্যাদা ও মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করা, মানসসম্মত শিক্ষা তথা সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা এবং প্রবীণ শিক্ষকদের অভিজ্ঞতাকে জানা ও কাজে লাগানো।

এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের মতে, সব দেশেরই বিশ্ব শিক্ষক দিবসকে স্বীকৃতি প্রদান এবং দিবসটি উদযাপিত হওয়া উচিত। শিক্ষকদের অধিকার, করণীয় ও মর্যাদা সুরক্ষায় ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ১৪৫টি সুপারিশ

গৃহীত হয়। এসব সুপারিশের মধ্যে শিক্ষকদের মৌলিক ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, দায়িত্ব ও অধিকার, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্যতম। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) উপর্যুক্ত সুপারিশসমূহ অনুমোদন করে।

১৯৯৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম অনুষ্ঠানে ৫ অক্টোবর দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৯৯৪ সালে প্রথমবার দিবসটি পালন করা হয়। তবে ১৯৯৫ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে শিক্ষকরা বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন শুরু করেন। ইউনেস্কোর অনুমোদনে প্রতিবছর পৃথক প্রতিপাদ্যে তা হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকরা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা, উপলব্ধি সৃষ্টি ও শিক্ষকদের ভূমিকার স্বীকৃতি স্মারক হিসেবে দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনির্মাণে শিক্ষকরা তাদের ভূমিকা রেখে চলেছেন।

বিশ্বব্যাপী শিক্ষক ইউনিয়নসমূহের ফেডারেশন এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) ও এর ৪০১টি সংগঠন এ দিবসের ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জনে ভূমিকা রাখছে। এ সংগঠন শিক্ষা পেশার অবদানকে তুলে ধরে প্রতিবছর জনসচেতনতামূলক প্রচার চালায়। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু এতবছর পরেও বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রকৃত মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারপরও শিক্ষকরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের শিক্ষাদান অব্যাহত রেখেছেন। তাই শিক্ষকদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে, তাদের যথাযথ সম্মান করতে হবে; যাতে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে আরও সাফল্যের সাথে। ১৯৬৬ সালে আইএল ও ইউনেসকো শিক্ষকদের পদমর্যাদার যে সুপারিশ করেছিল তার ৫০ বছর পূর্তি সূচিত করে, এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এক বছর পূর্বে বিশ্ব সম্প্রদায় গ্লোবাল এডুকেশন ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণের পর এবার প্রথম বিশ্ব শিক্ষক দিবস।

এ বছরের স্লোগান, শিক্ষকের মূল্যায়ন, তাদের পদমর্যাদার উন্নয়ন। উল্লেখিত এজেন্ডায় ৫০ বছর পূর্বেকার ঘোষিত মৌলিক নীতিমালার প্রতিফলন ঘটেছে যাতে টেকসই উন্নয়নলক্ষ্য নির্ধারিত হয়। এতে বিশেষ শিক্ষা নিশ্চিত করে এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শিক্ষকরা শুধু শিক্ষার অধিকার নিয়েই থাকবে না, তারা ঝউএ এ তে যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছে তা অর্জনে মূলশক্তি হিসেবে কাজ করবে নতুন এজেন্ডার রোডম্যাপ হলো-শিক্ষা ২০৩০ এর বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণ-যাতে উর্দ্ধে তুলে ধরা হয়েছে যে, ন্যায়সঙ্গত এবং গুণগত শিক্ষা অর্জনে শিক্ষকরা হলেন চালিকাশক্তি। এ জন্যই শিক্ষকরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, নিয়োগ, নারিশ্রমিক, উদ্বুদ্ধকরণে

সহায়তা লাভ করবে। সম্পদপূর্ণ, দক্ষ ও কার্যকর প্রশাসন পদ্ধতির মাধ্যমে।

এ লক্ষ্য অর্জনে শুধু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক সরবরাহ করলেই হবে না, শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে। ৩.২ মিলিয়নের উপর শিক্ষকের প্রয়োজন হবে বিশ্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে। বিশ্বজনীন নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনে প্রয়োজন হবে ৫.১ বিলিয়ন শিক্ষক। ইউনেসকো তার বিশ্বশিক্ষক দিবস উদযাপনকারী সংস্থা যেমন-আইএল ও ইউনিসেফ, ইউএনডিপি ও ইআই এবং শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাস্ক ফোর্স এ দিবস উদযাপনে আন্ত-সরকারি কমিটমেন্ট আদায়ে নিবেদিত থাকবে যাতে শিক্ষক সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মর্যাদার বিষয় নিরূপিত হয়, সেসব কমিটমেন্ট পেশার মূল্যায়নের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

শিক্ষকদের প্রতি করণীয় :

সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান :  শিক্ষকদের নিকট সমাজের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকগণ সমাজের প্রত্যাশা শতকরা যত ভাগ পূরণ করতে পারবেন সমাজও ন্যূনতম তত ভাগ সম্মান শিক্ষকদের দেবেন। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা নেই বলেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে এই পেশায় আসতে চান না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু বই পড়ে শিক্ষা লাভ করে সুনাগরিক হওয়া যায় না। একজন প্রকৃত সুনাগরিক গড়ে তুলতে হলে

সুশিক্ষার প্রয়োজন। সুশিক্ষার জন্য চাই নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞানী শিক্ষক। মেধাবী শিক্ষক ছাড়া সুশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব নয়। মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। একজন শিক্ষক যাতে তার পরিবার-পরিজনের লেখাপড়া, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ন্যুনতম চাহিদা মেটাতে পারে তার দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষকদের প্রয়োজন মেটাতে হবে। তাহলে একজন শিক্ষকের কোচিং-প্রাইভেট-টিউশনির দিকে উৎসাহ কমে যাবে। কারণ অনেক শিক্ষক ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিতান্তই বাঁচার তাগিদেও প্রাইভেট পড়ায়।

পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান :  মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, শিক্ষক পেশাগত ও সামাজিক নানা সমস্যায় জর্জরিত হবেন না। সে কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের পেশাগত মান উন্নয়নে শুরুতেই যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ ও তা অব্যাহত রাখা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং সঠিকভাবে তদারকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা :  নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সময়োপযোগী লক্ষ্য অর্জনে সকল স্তরের নাগরিককে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যমে শুধু লেখাপড়া নয়, মানুষের জ্ঞান, সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায় যা সুস্থ সমাজ ও উন্নত দেশ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং দেশের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সেই পরিকল্পনার মধ্যদিয়েই শিক্ষকদের আরও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

শিক্ষকদের ভূমিকার কথা তুলে ধরা :

মানব সন্তানকে শিক্ষিত করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে বলেই শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। মা-বাবা যেমন শিশুকে জন্মদান করে, লালন করে, তেমনি শিক্ষক তার সকল মেধা, শ্রম ও সাধনা দিয়ে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই বাংলাদেশের সকল শিক্ষকের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এদেশের সকল শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁদের ভূমিকার কথা তুলে ধরতে হবে; যাতে সামাজিকভাবে তাঁরা মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মূল্যায়ন :  প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে থানা, জেলা, বিভাগ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বাছাই এবং তাদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা উচিৎ। ভালো শিক্ষককে সম্মাননা ও আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান চালু করলে গুণগত শিক্ষাপ্রদানে শিক্ষকদের মাঝে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হবে।

শিক্ষকদের করণীয় :

সমাজের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট থাকা : সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞান তাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণি কক্ষে আগ্রহী পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আন্তরিক। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারী, পথ প্রদর্শক। অবশ্যই সৎ ও ধার্মিক। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নির্মল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী। সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতামনস্ক বিচক্ষণ সমাজ সংস্কারক। শিক্ষক হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন, পরিশ্রমী, নিরপেক্ষ, হাস্যোজ্জ্বল, সুপরামর্শক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

শেয়ার করুন