চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ইংরেজী শিক্ষা ও কিছু প্রশ্ন!

লিটন দাশগুপ্ত

৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:২৪ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজী ভাষা বিশ্বের আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। এই দুনিয়ার মানুষ যেখানে থাকনা কেন, এই ভাষার মাধ্যমে একে অপরের সাথে মনের ভাষা প্রকাশ করতে পারবে। যদি তার এই ভাষা বিষয়ে দক্ষতা থাকে।

অবাক বিষয় এবং মজার ঘটনা হল, আমাদের দেশে এই ইংরেজী শিক্ষা প্রাথমিকস্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সুচনা পর্যন্ত বাধ্যতামূলক। এখানে শ্রেণিভিত্তিক ইংরেজী শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রাথমিকস্তরে অর্থাৎ ১ম শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণিতে ১০০ নম্বর করে মোট ৫০০ নম্বরের শিক্ষাক্রম। আবার নি¤œমাধ্যমিক স্তরে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণিতে ১৫০ নম্বর করে মোট ৪৫০ নম্বরের শিক্ষাক্রম। আবার মাধ্যমিক স্তরে মানে ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে ২০০ নম্বর করে দুই বছরে মোট ২০০ নম্বর। একই ভাবে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে (একাদশ-দ্বাদশ) ২০০ নম্বর। ¯œাতক শ্রেণি বা উচ্চশিক্ষার প্রারম্ভে বাধ্যতামূলক ১০০ নম্বর। এই নিয়ে একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত (৫০০+৪৫০+২০০+২০০+১০০) =১৪৫০ নম্বরের বাধ্যতামূলক ইংরেজী বিষয় পড়তে হয় বা পড়তে বাধ্যকরা হয়। যা শিক্ষাবর্ষ হিসাবে ১৩ বছর।

গত ’১৬ সালের শেষের দিকে সরকারের সাবির্ক ব্যবস্থাপনায় ‘ট্রেনিং কাম স্ট্যাডি ট্যুর’ আওতায় ভিয়েতনামে গিয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। এখানে প্রাথমিক থেকে কোন স্তরের কোন শ্রেণিতে কোন ইংরেজী বিষয় বা ইংরেজী শিক্ষাক্রম নেই। সাধারণ শিক্ষার্থী বা প্রায় সব মানুষ ওয়ান অর্থ এক বা টু অর্থ দুই এইগুলো পর্যন্ত জানেনা, চিনে না ইংরেজী বর্ণমালা। এখানে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, অসাধারণ মানুষ যারা আছে তাদেরও একই অবস্থা। যেহেতু কোথাও ইংরেজী পড়তে হয়না বা পড়ানো হয়না, তাই ইংরেজী কোন বর্ণ বা শব্দও জানার কথাও নয়।

ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়, এই হ্যানয় শহরে ইংরেজী হরফে ভিয়েতনাম বা হ্যানয় লেখা আছে, এমন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ভবন, সড়ক-মহাসড়ককে কোন প্রকার সাইনবোর্ড পেলাম না, যেখানে দাঁড়িয়ে ভিয়েতনাম লেখার সামনে, স্মৃতি স্বরূপ একটি ছবি উঠাবো।

শুধু তাই নয়, সেই দেশের সীম কিনলাম; কিন্তু কথা বলার পর ব্যালেন্স সম্পর্কিত যে বার্তা আসে, তাতেও ভিয়েতী ভাষায় লেখা এবং কথাও ভিয়েতনামের ভাষার।

পুরো ভিয়েতনামে ইংরেজীর ‘ই’ কোথাও নেই। সেই দেশের ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ’ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মহাপরিচালক সহ অন্যান্য উর্দ্ধতন কর্মকর্তার সাথে শিক্ষা সম্পর্কীয় আমাদের বৈঠকেও দেখলাম, তারা তাদের ভাষায় কথা বলছে, আর গাইড বা দোভাষী আমাদের ইংরেজীতে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। জানতে পারলাম বিভিন্ন কারণে তারা, তাদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজী ভাষা তথা আন্তর্জাতিক ভাষাকেও প্রত্যাখান করেছে।

তারপরেও তারা অর্থাৎ ভিয়েতনামীয়রা শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে সমানতালে ও সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছে। একই রকম আরো অনেক দেশ আছে, যেমন- চীন, ফ্রান্স ইত্যাদির শীর্ষস্থানীয় দেশেও তারা নিজেদের ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজী ভাষাকে বাদ দিয়ে তারা কোন অবস্থায় কোন কিছুতে পিছিয়ে নেই।

এখন মনে আমার প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কেন ইংরেজী পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে?

আর বাধ্য হয়ে ইংরেজী পড়ে, কার্যক্ষেত্রে কতটুকু সুফল পাওয়া যাচ্ছে?

ইংরেজী ভাষা না জানার সত্ত্বেও কিছু দেশ কিভাবে শীর্ষস্থানে পৌঁছেছে, আবার কিছু দেশ কিভাবে শীর্ষের দিকে এগিয়ে চলেছে?

মাতৃভাষা বাংলা রক্তাক্ত হবার পরেও নিজ দেশে কতটুকু মর্যদা পাচ্ছে?

এই ধরনের প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে সম্পূরক আরো কিছু প্রশ্ন জাগে-

আমাদের দেশে ১ম শ্রেণি হতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ৮০০ নম্বর ইংরেজী বাধ্যতামূলক করলে ক্ষতি কি? পরবর্তী শ্রেণি অর্থাৎ ৯ম শ্রেণি হতে ইংরেজী বিষয় ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে অন্তুর্ভুক্ত করা কি যায় না?

এই রকম কত ধরনের প্রশ্ন আসে মনে! কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ‘ইংলিশ ইন একশন’ ট্রেনিং, বিভিন্ন ধরণের ইংরেজীর বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, ইংরেজী বিষয়ের জন্যে শত শত উপকরণ সংগ্রহসহ এই বিষয়ের জন্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। অথচ অন্য কোন বিষয়ে এই রকম অর্থ, সময়, শ্রম, ব্যয় হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ‘ইনপুট’ অনুযায়ী ‘আউটপুট’ পাচ্ছি কিনা ভেবে দেখতে হবে। আর না পেলে, না পাবার কারণও অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।

ইংরেজী বিশ্বের যোগাযোগ মাধ্যমের আন্তর্জাতিক ভাষা। সর্বক্ষেত্রে এর গুরুত্ব রয়েছে এটাও অস্বীকার করা যায় না। এখানে ইংরেজী শিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলছি তাও কিন্তু নয়। সব মানুষের ইংরেজী শিক্ষার উপযোগিতা আছে কি-না তাই ভাবছি। একটি উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করতে চাই। আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ, তাই কৃষি ভিত্তিক উদাহরণ দিয়ে বলি। যে কৃষক তার জমিতে বীজ বপন, ফসল উত্তোলন, ভুমি নির্বাচন, সার প্রয়োগ করবে; তার ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এই বিষয়ে

কৃষককে যে নির্দেশনা বা পরামর্শ দিবে, যেমন উর্দ্ধতন কৃষি কর্মকর্তা, তার ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ ঐ

কৃষি কর্মকর্তা ইন্টারনেট বা অন্য কোন ইংরেজী উৎস থেকে কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আজকে আমার এই  কথায় বা লেখায় অনেকের মতানৈক্য থাকলেও, হয়ত কোন এক সময় সংশ্লিষ্টমহল এই কথার যৌক্তিকতা খুঁজবে।

লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট