চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

টানা ক্লাস-কোচিং আর পরীক্ষার কবলে ছাত্রজীবন

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৬ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা সেক্টর এর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর এ খাতে নজর কাড়া পরিবর্তন হয়েছে। উন্নত দেশের মতো প্রতি ঘরে ঘরে, জনে জনে শিক্ষা অর্জনের স্পৃহা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষেরএ যুগে গোটা বিশ^ব্যাপী শিক্ষা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। শিক্ষার প্রতি মানুষ হুমকি খেয়ে পড়ছে। বিদেশে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ কড়ি সন্তানের উন্নত জীভনের কথঅ চিন্তা করে লাগামহীনভাবে বিপুল পরিমাণে খরচ করছেন অনেকে। দেশে রেখে যাওয়া পরিবার-পরিজন যেন শিক্ষা দীক্ষায় আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে প্রত্যাশা তাঁদের মনের গভীরে। যেভাবেই হোক সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষায় বড় করতে হবে। নজরকাড়া ফল অর্জন করতে হবে – উচ্চ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে আকাশ ছোঁয়া খ্যাতি কুড়িয়ে আনতে হবে। এক দিকে মা-বাবা, অভিভাবকদের তুষ্টি অপরদিকে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের মান বজায় রাখা – এ দুয়ের প্রত্যাশার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে শিক্ষার্থীর ছাত্রজীবন। এমন কোন শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না যারা ঘরে ও শিক্ষালয়ে লেখাপড়ার জন্য সকাল-সন্ধ্যা শারীরিক কিংবা মানসিক নিযাজন কিংবা প্রহারের শিকার হচ্ছে না। প্রায় প্রতি ঘরে শ্রেণিকক্ষে নজর করলে প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে এ দৃশ্য নজর কাড়বেই।

আমার ছোট মেয়ে ছোঁয়া। নগরীর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলটিতে বিশাল খেলার মাঠ, নজরকাড়া ফুল ফলের বাগান, খেলাধুলার আধুনিক উপকরণঅদি, মিনি শিশু পার্কসহ সহ শিক্ষা কার্যক্রমের প্রায় সব আয়োজন আছে। শিক্ষকদেরও খেয়াল দয়া মায়ার অন্ত নেই। স্কুলটির প্রতিষ্ঠালগ্নের ছাত্রী হিসেবে সে প্রথম থেকেই স্কুলে যাওয়ারজন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো। মাঝে মধ্যে আমরা বারণ করতাম কিন্তু ছোঁয়া চিৎকার করে আমি স্কুলে যাব আমি স্কুলে যাব বলে কান্না জুড়ে দিতো। স্কুলের প্রতি ছোঁয়ার সীমাহীন আকর্ষণ দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম। অসুখ-বিসুখ, ঝড়-গরম ও গায়ে জ¦র নিয়েও ছোঁয়া স্কুলে যেত। শুধু ছোঁয়া নয় তার সহপাঠীদেরও একই রূপ একই কথা। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যও ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষালয়মুখী করা।

শিক্ষালয়টিতে শিক্ষার আধুনিক সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও ছোঁয়া আগের মতো স্কুলে যেতে চায় না। সবার আগে স্কুলে গিয়ে সামনের বেঞ্চে বসার যে প্রবল আগ্রহ তার মদ্যে ছিল তা ক্রমে যেন ভাটা পড়ছে। সকাল বেলা ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। এভাবে কোনদিন হয়তো ডেকে তোলা সম্ভব হয় আবার হয় না এ দৃশ্যও কেবল ছোঁয়ার ক্ষেত্রে নয় বরং তাঁর সহপাঠীদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু কেন?

তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছোঁয়ার মোট পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা ১৩টি। বই-খাতা, ডায়েরী, সিলেবাস, টিফিনপাত্র ও আনুষাঙ্গিক মিলে ওর ছোট্ট কাঁধে বেশ বড়সড় ব্যাগের বোঝা বৈকি! ছবি অ৭াক, নাচ-গান- কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রমসহ মোটামুটি শুক্র-শনি এমন কী জাতীয় দিবসগুলোর বন্ধের দিনও তাকে স্কুলে যেতে হয়। সকাল ৮ থেকে টানা ১টা পর্যন্ত চলে স্কুল। ছাত্রদের বর্তমানে স্কুল মানে এক চরম ভীতিকর স্থান। স্কুলের পড়া বাড়িতে আর বাড়ির পড়া প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে তাও আবার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শিক্ষকদের সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে একেবারেই মুখস্থ বলতে হয়। ঘরে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষাতো মাস পেরিয়ে বছরের পর বছর গেলেও শেষ হবার নয়। শিশুর মুখ ফোঁটার পর থেকে শুরু হওয়া কায়দা, আমপারা থেকে পবিত্র কুরআন শরীফ অনেকে সারাজীবন ধরে পড়েও জবধফরহম পড়তে পারে না। শিক্ষালয় ও ঘর সর্বত্রই, ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে এ খেলা চলছে আমার মেয়েদের আমি যা পড়িয়েছি ঘরে প্রাইভেট হুজুর কিংবা শিক্ষালয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ, দোয়া-দরুদ শরীফ এর কোনটি তারা ততটা পড়ান নি। শিক্ষালয়ে পবিত্র কুরআন হাদীস আরবীতে পড়ানো হয় না বললেই চলে। গৃহ শিক্ষকরা এসব ধর্মীয় বই-পুস্তক কচ্ছপ গতিতে পড়ান বেশি দিন প্রাইভেট পড়ানোর জন্য। এতে করে কোমলমতি ছ্রাতদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। মোট কথঅ শিশুর শৈশব জীবন চলছে একের পর এক গদবাঁধা মুখস্থ বিদ্যায়। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, প্রথম ৩য় শ্রেণির ব্যাকরণ ও ইংরেজী গ্রামার বইয়ের সিলেবাস, কারিকুলাম, পরীক্ষা প্রশ্নপত্র, মানবন্টন দেখলে মনে হবে ছাত্রদের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা ডিগ্রি পড়ানোর দরকার হবে না। কারণ, এসব শ্রেণিতেই তা শেখানো হয়ে গেছে।

ছাত্ররাই আগামী দিনের কর্ণধার। কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।” আবার কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন : ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমরা তখন সে বয়সে লেখাপড়া কর মেলা।’ এ দেশে অনেক পশ্চাদপদ পরিবারের ছাত্র যারা ঠিকমতো আহার, বাসস্থান কিংবা প্রাইভেট থেকে বঞ্চিত তাদের সে খবর আমরা রাখি না। ছক বেঁধে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অংক ইংরেজী বিষয়ে পড়ার বাড়ির কাজ হিসেবে দিই। একই কথা শিক্ষালয়ের কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানে একজন পিয়ন কর্মচারী কত টাকা পান কিন্তু তাদের প্রতি আমরা অহরহ আদেশ নির্দেশ দিতে থাকি। তাদের মনের খরব রাখি না। একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান যে পরিমাপ আহার বিহার সেরে প্রতিষ্ঠানে আসেন একজন পিয়ন-কর্মচারীতো সে পরিমাণ পান না। এ কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। এসব বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক তাদের আর্থিক সামর্থ্য, শেখার পরিধি, শরীর-মন সর্বোপরি, পশ্চাদপদ পারিবারিক অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। সব শিক্ষকের কথা বলছি না। এখনো এ দেশে বহুত্যাগী শিক্ষক আছেন। মানবতাবাদী শিক্ষক আছেন। আদর্শ শিক্ষক ও আছেন। যাঁদের মাথার ওপর ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে এ মহান শিক্ষকতা পে শা। তবুও বলছি, এ সময়ে শিক্ষকদের ব্যবস্তা বেড়েছে। তাড়াহুড়ো করে ক্লাস শেষ খরে কোচিং প্রাইভেট কিংবা ছোট খাট ব্যবসায় বাণিজ্যে চলে যান। সপ্তাহে ৬/৭ দিনের পরিবর্তে এখন ৩ দিন পড়ান। ১ জনের পরিবর্তে একাধিকজন পড়ান। ফলে সেরা সার্ভিস দিতে পারছেন না। কোন কোন শিক্ষক কিংবা প্রতিষ্ঠান ছাত্রদের অব্যাহতভাবে ক্লাস প্রাইভেট কোচিং এবং নিত্য পরীক্ষা নির্ভর করে তুলছেন, নামী-দামী শিক্ষালয়ে এ তিনটি চলছেই। বিশাল সিলেবাস, অপরিমেয় চ্যাপ্টার/অধ্যায় শেষ হতে না হতেই চলছে টিউটোরিয়্যাল কিংবা মাসিক ত্রিমাসিক, ষান্সাসিক, বার্ষিক, সাপ্তাহিক, অধ্যায় ভিত্তিক পরীক্ষা। পরীক্ষার ভয়ে ছাত্ররা অতিষ্ঠ। কারণ, এসব পরীক্ষার মূল্য পাবলিক পরীক্ষার চেয়ে কোন কোন শিক্ষক-প্রতিষ্ঠানের নিকট বেশী। বলা বাহুল্য যে, এসব পরীক্ষায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব আছে। আছে অসংখ্য অনিয়ম-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ প্রাইভেট মুখীদের সাজেশন্স উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগের ফিরিস্তি আমরা সবাই জানি। পরীক্ষা হল জ্ঞান ও যোগ্যতা পরিমাপের উপায়। শিক্ষার্থী কতটুকু লেখাপড়া করল এর মাধ্যমে তা যাচাই করা কিন্তু আমাদের দেশে আজকাল শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষায় পাস করাকেই গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। তাই, ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক পরীক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এ জায়গায় সবাই অনিয়মের আশ্রয় খোঁজে। কেবল পরীক্ষায় পাস করাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের জীবন ঘুরপাক খাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো পরীক্ষায়ও ভেজাল মেশানো হচ্ছে। তাই প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন দরকার এবং তা কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। পরীক্ষার চেয়ে ছাত্রদের নিয়মিত টেকসই ক্লাস দরকার। শ্রেণি কক্ষই হোক থিউরিক্যাল ক্লাসের প্রাণকেন্দ্র। গুণগতমান সম্পন্ন ক্লাস নিশ্চিত করা গেলে পরীক্ষাসহ শিক্ষার অপরাপর বিষয়গুলো এমনিতেই এসে যাবে। বৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতি এবং যোগ্য শিক্ষক আর শিক্ষকের যোগ্যতানুযায়ী প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গেলে ছাত্ররা আনন্দময় শিক্ষার পরিবেশ পাবে।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। আমরা শিক্ষা চাই, মানসম্পন্ন ক্লাস চাই, ত্রুটিমুক্ত পরীক্ষা ও চাই কিন্তু এসব প্রত্যাশার কাছে যেন আমাদের ছাত্রদের শিশু-কিশোর ও ছাত্রজীবন বিপন্ন না হয় সেদিকে আমাদের সকলেরই নজর দেয়া দরকাল। তাদের পুষ্টি, পরিণতি, খেরাধুলা, ঘুরে বেড়ানো আড্ডা, শরীর মনে স্বাচ্ছন্দ্য স্বাভাবিক সুষ্ঠু বিকাশে আমাদের সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন করতে হবে। আমাদের দেশে ছাত্ররা বর্তমানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিকিৎসার চেয়ে বেশী উদ্বিগ্ন শিক্ষা নিয়ে। আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা ছাত্রদের শিক্ষা দিতে গিয়ে অতি শিক্ষাই বেশী দিচ্ছি। শিক্ষামুখী করতে গিয়ে তাদের মনে শিক্ষা বিমুখকতাই সৃষ্টি করছি বেশী। ক্লাস থেকে প্রাইভেট কোচিংমুখী করছি। অতএব, সাধু সাবধান!
টানা ক্লাস কোচিং আর পরীক্ষার পাশাপাশি ছাত্ররা যেন শিক্ষার স্বাদ পায়, তারা যেন শিক্ষালয়কে আনন্দ আশ্রম, শিক্ষককে অকৃত্রিম বন্ধু, নির্ভুল স্বপ্নদেষ্টা, তাদের জীবন গড়ার কারিগর সর্বোপরি, শিক্ষকের মধ্যে তারা যেন সত্য ও সুন্দরের পরম প্রকাশ খুঁজে পায়। শিক্ষা সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবক্ষেত্রে যেন আমাদের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকরা আনন্দ খুঁজে পায়। প্রত্যেকে যেন লাভবান হয়, সে চেষ্টা হোক আমাদের ব্রত। টানা ক্লাস, কোচিং পরীক্ষা আর লোভনীয় ফল অর্জনের প্রতিযোগিতার তোঁড়ে সরকার নির্ধারিত তালিকা থেকে কাটছাঁট করা হচ্ছে ছুটি, দুর্ঘটনার অন্তরালে বাতিল হচ্ছে বার্ষিক শিক্ষাসফর এ যেন মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা। আবার এগিয়ে থাকার বাসনায় শুক্র-শনি, জাতীয় দিবস কিংবা ঈদ-পূজা-পার্বনের বন্ধে দিনে ওচলে প্রাইভেট কোচিং। খ্যাতি রক্ষার্থে একশ্রেণির শিক্ষক ও এ ফাঁকে ছাত্র-অভিভাবককে লেখা-পড়া ও পরীক্ষা ভীতির অসংখ্য অজানা কাহিনী বলে কয়ে টানা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের চকবাঁধা বাণিজ্য। আামদের কোমলমতি শিক্ষার্থী, আনন্দময় শৈশব শিক্ষা ও ছাত্রজীবনের কথা মনে রেখে এ বিষয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় সুন্দর পরিবর্তন আনা দরকার। শিক্ষার পদ্ধতি, ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক কোচিং সেন্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠার মধ্যে চলা অসম ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধকল্পে এ পরিবর্তন অপরিহার্য।

লেখক : শিক্ষাবিদ, শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট