চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বিমা বাধ্যতামূলক করা হোক!

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার

২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:৩০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বিশ^ায়নের যুগে বিমা একটি বিকাশমান খাত হিসেবে গড়ে ওঠছে। কালের চক্রে এটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও পাচ্ছে। মানুষের জীবন ও সম্পদ নানা ধরনের ঝুঁকি ও

অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আবদ্ধ। যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে বিপদ ও দুর্ঘটনা। এতে করে ব্যাহত হতে পারে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনও ক্ষতি হতে পারে অর্জিত সম্পদ। একজন ব্যক্তির মৃত্যুতে যেমন নেমে আসতে পারে গোটা পরিবারে অন্ধকার, তেমনি কর্মক্ষম ব্যক্তির অসুস্থতার কারণে নিজে এবং পরিবারটি হতে পারে আর্থিকভাবে অসহায়। একজন শিক্ষক-কর্মচারীও মানুষ। তাঁদের জীবনেও যেকোন সময় নেমে আসতে পারে বিপদ ও দুর্ঘটনা। নিজের জীবনকে ঘিরে ঝুঁকি ও
অনিশ্চয়তার অজানা আশঙ্খায় দেশের শিক্ষক সমাজ উদ্বিগ্ন। শিক্ষকদের চেয়ে কর্মচারী বিশেষ করে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীবৃন্দ আরো বেশি উদ্বিগ্ন।

বর্তমান যুগে বিমা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি পরীক্ষিত রক্ষাকবচ। গোটা বিশ^ব্যাপী বিমার বদৌলতে ব্যক্তিজীবন, ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, সম্পদ বিনিয়োগ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ইত্যাদি অনেকটাই ভাবনাহীন। বর্তমান সরকার এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ঘর বাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে ঝুঁকিপূর্ণ সব ক্ষেত্রে বিমা ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের এ ধরনের তৎপরতাকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং সে সাথে এ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে দেশের সবশ্রেণির শিক্ষক-কর্মচারীদেরও সম্পৃক্ত করার জন্য বিনীত আবেদন জানাই।

আমরা ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষকরা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এমন কি বিবিএ (অনার্স) শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের ইধহশরহম ধহফ ওহংঁৎধহপব – ঞযবড়ৎরবং, ষধংি ধহফ অপপড়ঁহঃং বিষয়ে পড়াই। অথচ, শিক্ষক-কর্মচারীদের বাস্তবে বিমার সাথে সম্পৃক্ত নেই বললেই চলে। বলতে দ্বিধা নেই যে, সমাজের এ বিশাল অংশকে বাদ দিয়ে দেশের প্রকৃত উন্নয়নও সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণেই জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি ভাবনাহীন পেশাজীবী গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সর্বোপরি, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে গোটা দেশের শিক্ষক-কর্মচারী সমাজের জন্য বিমা চালু করার উদ্যোগ বাধ্যতামূলক করা হোক। যাতে করে শিক্ষক-কর্মচারী সমাজ মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারে। মানুষ যখন পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল তখন থেকেই বিভিন্ন প্রকার বিপর্যয়, ক্ষতি ও অসহায়ত্ব ও আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছে। এসব বিপর্যয়, ক্ষতি ও অনাকাংখিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে মানুষ গুলো হতে সংগঠিত আর্থিক ক্ষতি লাঘব এর একটি পথ আবিষ্কার করে। আর তা হলো বিমা নামক আর্থিক নিশ্চয়তা। শিক্ষক-কর্মচারীরাও মূলত এ আর্থিক নিরাপত্তা চায়, মানুষের জীবন মূলত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তায় গড়া। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, ভবিষ্যত সবসময়ই অনিশ্চিত, ভবিষ্যতে কি ঘটবে এ সম্পর্কে কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না। ক্ষয়-ক্ষতি, বিপদ-আপদ এবং কাঙ্খিত বস্তু হারানোর ভয় প্রত্যেকের মনে ক্রিয়াশীল। সে হিসেবে এ প্রবণতা শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে থাকাও স্বাভাবিক। মানুষের জীবনে ঝুঁকিও বিদ্যমান। ভবিষ্যতে কোনো ঘটনা ঘটতেও পারে আবার নাও ঘটতে পারে। ঝুঁকি আমাদের সাফল্যের উদ্দীপনাকে থামিয়ে দেয়। যখনই কোন কাজে হাত দিতে যাই তখনিই ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা এসে দেয়াল হয়ে সামনে দাঁড়ায়। অভ্যন্তরীণ যথা : কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া, অসন্তোষ, পদত্যাগ, চাকরি হারানো, ব্যবসায় লাঠে ওঠা এবং মৃত্যু। আবার

প্রাকৃতিক ঝুঁকি যেমন : বন্যা, ভূমিকম্প, অগ্নিকা-, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি আর অর্থনৈতিক ঝুঁকি যেমন : রুচি ও চাহিদার পরিবর্তন, আমদানী, রপ্তানি, বেকারত্ব, রাজস্বনীতি ইত্যাদি অপরদিকে মানবিক ঝুঁকি কম নয় যেমন: হরতাল, অবরোধ, চুরি ছিনতাই-ডাকাতি, যুদ্ধ বিগ্রহ আর সবশেষ ঝুঁকির সংযোজন হল প্রযুক্তিগত যথা : প্রযুক্তি ও কৌশলের পরিবর্তন, অপচয়, নতুন নতুন আবিষ্কার ইত্যাদি।
সুপ্রিয় পাঠক, আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার করাল গ্রাস থেকে মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা দিতে বিমা কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই, বিভিন্ন দেশের সরকার কিংবা কোম্পানি তাদের কর্মীদের সম্ভাব্য ক্ষতির বিপরীতে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হাতিয়ার হিসেবে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির ধরন অনুযায়ী জীবন বিমা, নৌ বিমা, অগ্নিবিমা ও দুর্ঘটনা বিমার আওতায় নিয়ে আসছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে বিমা

গ্রহিতারা আর্থিক ক্ষতি হ্রাসের জন্য এবং বিমাকারীরা অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো মুনাফা লাভের উদ্দেশে বিমার কার্যক্রম পরিচালিত করলেও বর্তমানে বিমা ব্যবস্থা নানামুখী কল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন করছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের কর্মজীবন নিরাপদ মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু তা নয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক-অনার্থিক ঝুঁকি আছে। স্বল্প ও সীমিত আয়ের পেশা বলতে মূলত শিক্ষকতাকেই বুঝিয়ে থাকে। গতিশীল-পরিবর্তিত বাজার ব্যবস্থায় স্বল্প রোজি-রোজগারের পেশায় শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের জীবন-জীবিকা ছেলে-মেয়ে স্ত্রী-পুত্রের, রোগ শোক, অঙ্গ হানি, অন্ন, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, তীর্থ ভ্রমণ, সীমিত পর্যায়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ পরিচালনা করা এসবের কোনটিই ঠিকভাবে চলছে না। বিশেষ করে পরিবারের মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-সন্তানের চিকিৎসা ও শিক্ষার ভার বহন করা মোটেও সম্ভব হচ্ছে না। বড় ধরনের কোন অসুখ-বিসুখের চিকিৎসার ভার বহন করা বিদেশ তো দূরের কথা দেশেও সম্ভব হয় না। সহশিক্ষা কিংবা সহপেশা কার্যক্রম যথা : গবেষণা, পুস্তক প্রকাশ, উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ, দেশ-বিদেশ কিংবা দর্শনীয় স্থানে গমন, ইবাদত-উপাসনাগারে গমন, সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করার মত সার্মথ্য একজন শিক্ষকের নেই বললেই চলে। সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের খানিকটা প্রাপ্তি থাকলেও বেসরকারী শিক্ষকদের তা নেই বললেই চলে।

আমাদের দেশে শিক্ষকতা একটি পশ্চাৎপদ পেশা। এ পেশার আর্থিক-অনার্থিক প্রেষণা কচ্ছপ গতিতে বাড়ছে বটে কিন্তু তাও অপরাপর পেশার তুলনায় নিতান্তই কম। অবশ্য এর জন্য আমাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতাই বেশী দায়ী। রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাতান্ত্রিকতা যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষক প্রতিনিধির অভাবে এ মহান ও মর্যাদার পেশাটি মুখ থুবড়ে আছে। আমাদের দেশ ষড়ঋতুর বিচিত্র দেশ। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত সবই আছে। দেশের জন্য বিমা একটি লাভজনক খাত হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে। প্রকৃতি আপন হাতে এ দেশকে বিমার জন্য উপযুক্ত করে রেখেছেন। জীবন বিমা, অগ্নি বিমা, নৌ বিমার মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য নামমাত্র প্রিমিয়ামের মাধ্যমে চালু করা যেতে পারে। ভূমিকম্প, পাহাড় ধস, নদী ভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ফসল হানি, চুরি-ডাকাতি, মূল্যবান দ্রব্যাদি খোয়া যাওয়া, অগ্নিকা-, গ্যাস সিলি-ার বিস্ফোরণ, গাড়ি দুর্ঘটনা, মাছ পশু পাখির মড়ক লাগাসহ যে কোন দুর্যোগ দুর্বিপাকে বিমা ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। শিক্ষক বিশেষ করে কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ও বিয়ে বিমা অপরিহার্য। ৩য়-৪র্থ শ্রেণির প্রায় কর্মচারীকে তাঁদের সন্তানদের বিয়ে-সাদীতে হাত পাততে দেখা যায়। কিন্তু এ দৃশ্য আর কতকাল দেখতে হবে। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে বিয়ে ও শিক্ষাখাতে ভিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে বিমা ব্যবস্থা চালু করতে পারেন। সরকারি-বেসরকারী উভয় পর্যায়ে দেশে বিমার যথেষ্ট সম্ভাবনার খাত কেবল শিক্ষা সেক্টরেই গড়ে উঠতে পারে। এখন কেবল আগ্রহী উদ্যোক্তার-উদ্যোগই যথেষ্ট।
আমাদের দেশে সরকারি আমলাদের মন ও মগজ দুটোই সতেজ। নিজেদের আর্থিক অনার্থিক দুটোই তাঁরা ঢাল-তলোয়ার, আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়াই আদায় করতে জানেন। এ নিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠ গত ২৪ জুলাই ২০১৯ তারিখে একটি নজর কাড়া সংবাদ ছাপিয়েছেন। ‘সুযোগ-সুবিধার পাহাড়ে সরকারি কর্মচারীরা।’ সরকারি কর্মচারী

আমলারা ছাত্র জীবনে মেধাবী ছিলেন সেই থেকে শিক্ষাবৃত্তি, বিনা বেতনে অধ্যয়নসহ সরকারি শিক্ষালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়ে ছিলেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও শিক্ষকদের একান্ত সান্নিধ্যও লাভ করেছেন তাঁরা। প্রতিবেশি, সমাজ, আত্মীয়-স্বজন এমনকি বিভিন্ন সামাজিক সংঘ থেকেও তাঁরা সম্মান কুঁড়িয়েছেন। আর কর্মজীবনে অঢেল মর্যাদাতো পাচ্ছেনই। যেমন : সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারের আগে সরকারের অনুমতি নেয়া। বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতো নিত্য বিষয়মাত্র। এছাড়া ঝুঁকি ভাতা, ইন্টারনেট ও মোবাইলে কথা বলার খরচ, অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া খরচ, সন্তানদের শিক্ষা ভাতা, চাকরিরত অবস্থায় পঙ্গু হলে কয়েক লাখ টাকা – মারা গেলে তার কয়েকগুণ বেশি, একই অবস্থায় ঋণ থাকলে সেটিও মওকুফ। প্রশিক্ষণে অংশ এবং প্রশিক্ষণে লেকচার দেয়ার ভাতা দ্বিগুণ হয়েছে। উর্ধ্বতনদের বাবুর্চি, প্রহরী বিলও বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া মৃত্যুর পর স্ত্রী-স্বামীর ভরণ পোষণসহ অনেক সুবিধাই দেওয়া হয়েছে। দেয়া হচ্ছে বৈশাখি ভাতা, চালু হয়েছে হাওর ভাতা। সম্মানিত উপ-সচিবদের গাড়ির জন্য বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা ঋণ ও সেটা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মাসে ৫০ হাজার টাকা ছাড়াও কর্মচারীদের বাড়ি করতে ৫ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দসহ অবসর ভাতাতো আছেই। সরকারের সুনাম এবং রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে আরো সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা যেন তারা পায়- আমরা সেটাই কামনা করি। তবে, একটি উন্নয়নগামী দেশ হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি দেশের সব শিক্ষক কর্মচারী যথা : সরকারি-বেসরকারী, এমপিও-ননএমপিও, সরকারিকরণকৃত ও ট্রাস্ট কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্তদের একটি নীতিমালার ভিত্তিতে একক, যৌথ অথবা নতুন কোন নিয়ম প্রণয়ন করে সারাদেশের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বিমা ব্যবস্থা অপরিহার্য হিসেবে চালু করা দরকার। একজন শিক্ষক এর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সর্বোপরি পেশাগত নিরাপত্তা ও মর্যাদা বিকাশে বিমা তাঁদের পথের দিশারী হয়ে উঠুক। এবং তা বর্তমান সরকারের হাতেই সফলতা লাভ করুক – এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট