চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নতুন শিক্ষাক্রম: সম্ভাবনা ও সামাজিক রূপান্তর

অনলাইন ডেস্ক

২৯ মে, ২০২৩ | ৮:২৩ অপরাহ্ণ

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। কী কী যোগ্যতা অর্জন করলে শিক্ষার্থীরা এই সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে সেগুলোকে বিবেচনার কেন্দ্রে রেখে প্রাকপ্রাথমিক হতে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সব শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা শিক্ষকদের রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর বিকাশ ও উৎকর্ষে সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরেও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ সৃষ্টি ও স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক, একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়বস্তুভিত্তিক নয়। এই নতুন শিক্ষাক্রমে দর্শন এবং ভাবনা অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা মতামতের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

অর্থাৎ থিংকিং অ্যাক্টিং এক্সপেরিয়েটিং রিফ্লেক্টিং বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক মানের লেখাপড়ার সঙ্গে সমন্বয় রেখে শিক্ষার্থীরা কীভাবে শিখবে তার ওপর এ শিক্ষাক্রমটি বিশেষভাবে আলোকপাত করে। এই শিক্ষাক্রম দেশজ মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এবং গত্ বাধা ভাবনা ও সংস্কারকে প্রশ্ন করতে শেখায়। সহজলভ্য শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে উত্সাহিত করে এবং স্বাধীনভাবে শিখতে সাহায্য করে। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চাপ নেই, রোল নম্বরের টেনশন নেই, ক্লাসের পড়া ক্লাসেই বুঝতে পারবে, প্রাইভেট ও কোচিং-নির্ভরতা কমে আসবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন শিক্ষার্থীকে আর প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে না। জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে সে কতটা পারদর্শিতা অর্জন করেছে, তার ভিত্তিতেই তাকে মূল্যায়ন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে শিক্ষার্থীকে শিখনকালীন মূল্যায়ন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। বছর জুড়ে চলমান থাকবে শিখনকালীন মূল্যায়ন আর বছরে ছয় মাস অন্তর দুটি সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। পাঠ চলাকালীন সময়ে নির্ধারিত কাজ, দলগত কাজ, সমস্যা সমাধানমূলক কাজ, মৌখিক উপস্থাপনা, রিপোর্ট তৈরি, মাঠ পরিদর্শন ইত্যাদি কাজে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম দেখে পারদর্শিতার সূচকে (পিআই) শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা নিরূপণ করা হবে।

এছাড়া প্রত্যেক শিখন অভিজ্ঞতায় শিক্ষার্থীর সার্বিক আচরণগত দিক মূল্যায়ন করার জন্য তাদের আচরণগত সূচক (বিআই)-এর মাত্রা নির্ধারণ করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে জুন মাসে সামষ্টিক মূল্যায়ন-১ এবং ডিসেম্বর মাসে সামষ্টিক মূল্যায়ন-২ অনুষ্ঠিত হবে। পূর্বঘোষিত এক সপ্তাহ ধরে এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হবে। স্বাভাবিক ক্লাস রুটিন অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের জন্য নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য অর্পিত কাজ সম্পন্ন করবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও সফলতার জন্য সবার আগে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় সকল শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে। এই প্রথম শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সহায়ক গাইড (টিজি) এবং বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন নির্দেশিকা সরবরাহ করেছে। যদি শিক্ষকগণ প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত নির্দেশনা, শিক্ষক সহায়ক গাইড, মূল্যায়ন নির্দেশনা পরিপূর্ণভাবে মেনে চলেন তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম শতভাগ সফল হবে বলে আশা করা যায়।

আগের শিক্ষাক্রম ছিল প্রতিযোগিতামূলক আর নতুন শিক্ষাক্রম হচ্ছে সহযোগিতামূলক, যেখানে শিক্ষার্থীরা পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে। যদিও অভিভাবকদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, এই কারিকুলামে পরীক্ষা নেই কিন্তু বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসভার মাধ্যমে নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে জানার পরে তাদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান হয়েছে এবং নতুন কারিকুলামকে খুব সহজভাবে নিয়েছে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য অভিভাবকদের এ কারিকুলামের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।

৬ষ্ঠ এবং ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে গেলে লক্ষ্য করা যায় প্রাণের স্পন্দন। নতুন কারিকুলামকে তারা খুব সুন্দরভাবে গ্রহণ করেছে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষকতা নিছক একটি পেশা নয়, এটি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে এসডিজি-০৪-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে আজকের শিক্ষার্থীকে ২০৪১ সালের উন্নত বিশ্বের স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সকল আয়োজন সার্থক হবে।

উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদাকে ধরে রাখা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে বর্তমান শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই বাস্তবায়িত হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩। তথ্যসূত্র: ইত্তেফাক

লেখক: প্রধান শিক্ষক, মডেল একাডেমি, মিরপুর-১, ঢাকা

শেয়ার করুন