চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

গুরু শিষ্যের ইমেজ সংকট

মো. সেলিমুজ্জমান মজুমদার

২৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:৩২ পূর্বাহ্ণ

আমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ের ছাত্র। ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াই। কিভাবে ব্যবসায় শুরু হয়েছিল, কিভাবে ব্যবসায় চালানো উচিত? কোন পথে ব্যবসায়ের উন্নতি, কোন পথে অবনতি? কেন আমরা ব্যবসায় করবো? কোন পথে আমাদের শেষ পর্যন্ত
লাভটাই বেশি? ইত্যাদি! শ্রেণিকক্ষে একজন ব্যবসায়ীর মতো প্রথম কথাটা লাভ দিয়ে শুরু এবং লাভ দিয়েই শেষ করি। মাঝে মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম-কর্মসহ সমসাময়িক বিষয়েও ধারণা দিয়ে থাকি। পরীক্ষার হলে উত্তরপথে স্বাক্ষর করতে করতে ছোটখাটো আলাপচারিতাও করি। যেমন- তোমার নাম এর অর্থ কী? আজকে যে পরীক্ষা দিচ্ছ সে বিষয়টির পুরো নাম কী? কোন শিক্ষক বিষয়টি পড়ান? তোমার প্রতিষ্ঠান প্রধান বা সহ প্রধানের নাম কী? তোমার হাতের লেখা ‘অক্ষরমাত্রা’ রক্ষা হচ্ছে না। পরীক্ষা শুরুর আগে ছোটখাট উপদেশমূলক বক্তব্যও পেশ করি। আদরের পরীক্ষার্থীবৃন্দ আমার কথা শোন। পরীক্ষার হল পবিত্র স্থান এবং সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা কথা বলা কিংবা আলাপচারিতার স্থান নয়। আমরা দু’তিন ঘণ্টার খ্বুই কঠিন সময় পার করবো। চোখ বন্ধ কর। বিধাতাকে বল, আমরা তোমার সাহায্য চাই। মনকে ন্যূনতম ৩ বার বল, আমি পরীক্ষার হলে বসেছি সব প্রশ্নের উত্তর করবো। যে যেই ধর্মে বিশ^াস কর সে, সেই ধর্মের প্রার্থনা কর। মনকে স্থির কর এবং পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই মনকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে এসো। আমার কথা শুনে পুরো হল রুম স্তব্ধ হয়ে যায়। গোটা কক্ষ নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পরীক্ষা ভয় পাবার কিছুই নেই- আমরা শিক্ষকরা তোমাদের সাথে আছি। তোমরা ধৈর্য্যসহকারে লিখতে থাকো, দেখবে আমরা সবাই ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। যেমন কথা, তেমন কাজ। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীরা পা ছুঁয়ে, কেউ লম্বা সালাম করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে, স্যার, খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছি।
স্যার আপনি কী এ কলেজের শিক্ষক? সামনের পরীক্ষায় কী আপনি এ হলে গার্ড পড়বেন? কোন এক পরীক্ষার হলে একজন শিক্ষকের রুঢ় আচরণ দেখে একজন পরীক্ষার্থী আমাকে একবার ফিস্ ফিস করে জিজ্ঞাস করলেন, ‘স্যার উনি কী এ কলেজের শিক্ষক? নাকি প্রাইমারী স্কুলের? উনি পরীক্ষার হলে আমাদের সাথে এমন রূঢ় আচরণ করছেন কেন? আমি বিব্রত বোধ করলাম এ পরীক্ষার্থীর প্রশ্ন শুনে। হয়তো তাঁর এ প্রশ্ন আজীবন আমার কানে বাজবে। শ্রেণিকক্ষে ঢুকে যখন ছাত্র-ছাত্রীদের ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলি- তখন সমবেত কণ্ঠে সালামের জবাব শুনতে যে কী মেলোডী সুর তার একজন শিক্ষক ইচ্ছা করলেই অনুভব করতে পারেন।
সুপ্রিয় পাঠক, ছাত্র-শিক্ষক বা গুরু-শিষ্য সম্পর্কটা একটা স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় নেতিবাচক কিছু হলেই বিভ্রান্তি ছড়ায়। প্রিন্ট ও আকাশ মিডিয়ার বদৌলতে পুরো বিষয়টা হয়ে পড়ে ভীষণ আবেগের। অথচ আবেগ দিয়ে শিক্ষকতা চলে না। সমস্যার সমাধান করা যায় না। শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী বিপদে পড়লে, তাদের পড়ালেখায় কোন সমস্যা দেখা দিলে শিক্ষকরা তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। এটা প্রমাণিত। এতদসত্ত্বেও, শিক্ষকতায় ভুলভ্রান্তি আছে। অনিয়ম আছে। গাফিলতি আছে, দুর্নীতিও আছে। আছে কোমল-কঠোরতা। সবই আছে। তবে, সামগ্রিকভাবে উন্নতির দিকেই বেশী। ইতিবাচক দিকগুলো না বলে শুধুই যদি নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয় তাহলে তো এগিয়ে যাওয়ার কোনো পথ থাকে না। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘঠিত গুরু-শিষ্যের সামাজিক অবক্ষয়ের নেতিবাচক ঘটনাগুলো একজন শিক্ষক হিসেবে আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। শিক্ষকতা কঠিন কাজ। শত সহ¯্র ধরনের কাজ ও পলিসি। লেখাপড়া করানো শিক্ষকের কাজ। লেখা পড়া আর প্যাক্টিক্যালের জন্য নাকি নানা অজুহাতে শিক্ষকদের অর্থ কড়ি দিতে হয়। শিক্ষকতায় ভালো থেকে মন্দকে তফাৎ করতে হবে। ব্যবসায়িক ও অনৈতিকতায় বিশ^াসী শিক্ষকদের কবল থেকে শিক্ষকদের আলাদা করে দেখতে হবে। বক ধার্মিক ও চরিত্রহীন শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদেরকেই বয়কট করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের জনপ্রিয়তা ও শিক্ষার্থীদের নিকট তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। যোগ্যদের মূল্যায়ণটাও যথাযথ হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা পত্রিকায় লিখে শিক্ষকদের অযোগ্যতা তুলে ধরেছে কিন্তু কোন ফল হয় নি উপরন্তু উল্টো ফল হয়েছে। অন্যায়কারীরা বাহাদুরি করে চলতে পারে বলেই আজকে শিক্ষালয়গুলোতে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে চরমভাবে। একথা কেবল শিক্ষকের বেলায় নয় অনেক প্রভাবশালী শিক্ষার্থীর জন্যও তা প্রযোজ্য।
যিনি আমাদের শিক্ষা দেন তিনি শিক্ষক। পৃথিবীতে সব চাইতে সম্মান ও মর্যাদার পেশা হলো শিক্ষকতা। আমার জীবনে এমন বহু আদর্শিক জ্ঞানের শিক্ষক-শিক্ষিকা পেয়েছি যাঁরা উত্তম আদর্শের ভিত্তিতে ছাত্রদের পড়াতেন। বস্তুত শিক্ষকদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছি। আমি তাঁদের ঋণ স্বীকার করছি এবং মৃতদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি। শিক্ষকতাকে নিজের জীবনের পেশা ও ব্রত হিসেবে নিয়ে বহু প্রাপ্তি, সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছি। শিক্ষকতায় অর্থ কড়ি কম, সামাজিক মর্যাদা নেই বললেই চলে, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক তলানীতে পৌঁছে গেছে, কেউ কাউকে মানতে চায় না। শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতার চরমভাবে ধ্বসে পড়ছে। বিনয়, ন¤্র, ভদ্রতা,
¯েœহ-মমতার পরিবর্তে একের প্রতি অন্যের সন্দেহ ও অবিশ^াস দানা বেঁধেছে। গুরু-শিষ্যের নির্মমতা সংবাদপত্রের নিত্য সংবাদ।
অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের
লেখাপড়া ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অজানা আতঙ্কে আতকে ওঠেন। কোন না কোন পর্যায়ে তাঁরা শিক্ষকের নিকট সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। বস্তুত এসব নেতিবাচক চিন্তা-চেতনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরু-শিষ্যে ইমেজ সংকট চরমে পৌঁছে গেছে।
আগেই বলেছি যে, আমি ব্যবস্থাপনার ছাত্র। ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্বন্ধে পড়াই। ব্যবসায়ে লাভ করার কৌশল শেখানোই আমার কাজ। অথচ, গেল কয়েকদিন আগে টেলিভিশনের কোন একটা চ্যানেলে একটি ভক্তিমূলক গান শুনলাম। গানটি কেন জানি গুরু-শিষ্যের বিষয় হিসেবে ছাত্র, শিক্ষক এর সম্পর্ক সম্বন্ধে মনে করে দিল। বিষয়টি আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হওয়ায় এ বিষয়ে লেখার প্রয়োজন অনুভব করলাম এবং শ্রেণিকক্ষে এ বিষয়ে একটি অনুভাষণও দিলাম গানটি হল মোটামুটি এরকম- ‘যে শিষ্য হয় – গুরুর মনের খবর লয়। গুরু-শিষ্যের এমন ধারা যেমন চাঁদের হাটে তাঁরার মেলা। গুরু-শিষ্যের এমন ধারা যেমন হাতের মুঠোয় ছায়া ধরা।’ শিক্ষক পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র পক্ষান্তরে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক। গুরু-শিষ্যে একে অপরের আপনজন হবেন একের সঙ্গে অপরের আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠবে এটাইতো সকলের একান্ত কাম্য।
একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বর্তমানে
সিংহভাগ শিক্ষক ছাত্রদের নাম জানেন না। একইভাবে ছাত্ররাও শিক্ষকের নাম জানে না। প্রিয় পাঠক, আপনার সন্তানকে প্রতিবেশী শিক্ষার্থীকে তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের নাম জিজ্ঞাস করুন, শিক্ষার্থীর পঠিত বিষয়গুলোর নাম জিজ্ঞেস করুন, দেখবেন অনেকেই তা পারছে না। শুধু তাই নয় -শিক্ষার্থীর ধারণা প্রাইভেট, টিউশনি, কোচিং না করলে শিক্ষক তাঁদের ফেল করিয়ে দেবেন, তার উত্তরপত্র ঠিকভাবে মূল্যায়ন হবে না। প্রাইভেট পড়লে পরীক্ষার আগে শিক্ষক প্রশ্নপত্রের নমুনা সরবরাহ করবেন, নচেৎ তার কপালে নিশ্চিত খারাবী আছে। অপরদিকে শিক্ষকের অভিযোগ হল বর্তমানে ছাত্ররা পড়ালেখা করে না, ক্লাস করে না, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দেয় না। টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। সারাক্ষণ কম্পিউটার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বাদ দিয়ে বিভিন্ন কোচিংয়ে ছাত্র মাস্টারদের কাছে যাই। ঠিক মতো উত্তর সাজিয়ে লিখতে পারে না। খাতায় না থাকলে নাম্বার দেব কোথা থেকে ইত্যাদি। মাঝখানে অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। এ যে পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ^াস, সন্দেহ ও বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গিটা গুরু-শিষ্যের ইমেজ সংকট সমাজের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমাদের শিক্ষার ওপর পড়ছে যা এখনি সুরাহা হওয়া দরকার।
নতুন প্রজন্মকে আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য সর্বাগ্রে দরকার বিশ^মানের শিক্ষাজ্ঞান এবং দক্ষতা। এ লক্ষ্যার্জনে সর্বাগ্রে আমাদের শিক্ষক সমাজকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিষয়ক কলামিস্ট

শেয়ার করুন