চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পাওয়া মেয়েটি মেডিকেল শিক্ষার্থী

পূর্বকোণ ডেস্ক

১৩ এপ্রিল, ২০২১ | ৯:০৬ অপরাহ্ণ

অসুস্থ নানা মরার আগে নাতজামাইয়ের মুখ দেখার আবদার রক্ষা করতে গিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া বালিকা জান্নাতীর বিবাহ ঠিক করে পরিবার।  কিন্তু জান্নাতী নিজেই বেঁকে বসলেন বিয়েতে। এত অল্প বয়সে বিয়ে করতে মোটেই রাজি নয় সে। তার স্বপ্ন লেখাপড়া করে নিজের পায়ের দাঁড়াতে হবে। এ জন্য কেঁদেকেটে নিজের ইচ্ছের কথা বলেছিলেন বাবাকে। মেয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বন্ধ হলো বিয়ের সব চিন্তাভাবনা।

এ ঘটনার কয়েক মাস পর জেএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এ পরীক্ষায়ও তিনি মেধাবৃত্তি পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য জেএসসির এই সাফল্যের পর আর কোনো স্বজন জান্নাতীর বিয়ের ঘটকালি করতে আসেননি। পরে জান্নাতী আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করেন।

কিন্তু কে জানত, দরিদ্র পরিবারের সেই অদম্য মেয়েটি মেডিকেলে উত্তীর্ণ হবেন? ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন জান্নাতী।

চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার আসাননগর গ্রামের খোরশেদ আলম বাবলু ও ফাতেমা আক্তার দম্পতির সন্তান জান্নাতী। তিন বোনের মধ্যে জান্নাতী বড়। খোরশেদ আলম বাবলু সদ্য সরকারীকৃত আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বাড়ির সামান্য জমি ছাড়া চাষাবাদের একচিলতে জমিও নেই। তার স্বল্প আয় দিয়েই চলে পুরো সংসার, চলে তিন মেয়ের লেখাপড়া।  মা ফাতেমা আক্তার নিপুণ গৃহিণী।

জানা যায়, জান্নাতী প্রথমবার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন। তবে সেবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ভর্তি হয়েছিলেন জুওলজিতে। কিন্তু মন যে তার পড়ে ছিল মেডিকেলের বইয়ের ভেতর। তাই এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো আবার তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। দ্বিতীয়বার ঠিকই উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে। দ্বিতীয়বার পরীক্ষার দরুন ৫ নম্বর কেটে নেওয়ার পরও তার জাতীয় মেধাতালিকায় স্কোর দাঁড়িয়েছে ২৭০।

শুধু দারিদ্র্য না, সমাজের নানা অনিয়মের সঙ্গেও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর জান্নাতী। তিনি বলেন, একবার পরীক্ষা হলেও অপ্রিয় ঘটনা চরম মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার নির্ধারিত সময় শেষ। আমাদের কাছ থেকে উত্তরপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিদর্শক শিক্ষক কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে সময় শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে ১০ মিনিট করে অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। শুধু কি এইচএসসি পরীক্ষা? মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েও অনিয়ম দেখেছি। যন্ত্রণায় হৃদয় ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনি। এসব অনিয়ম আমার ভেতরে বড় হওয়ার জেদ সৃষ্টি করেছে।

জান্নাতী বলেন, আমার এ সাফল্যের পেছনে শিক্ষকদের অনেক অবদান রয়েছে। বিশেষ করে আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আনিসুজ্জামান ও আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের শিক্ষক ফারুক হোসেনের সহযোগিতা কোনো দিন ভুলব না। অন্য শিক্ষকরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। বাবা কলেজের স্টাফ। তাই প্রাইভেট পড়িয়েছেন বিনা মূল্যে। হাইস্কুলে পড়াকালীনও প্রাইভেট শিক্ষকরা অর্ধেক টাকা নিয়েছেন।

আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কৃষিবিদ গোলাম ছরোয়ার মিঠু ও প্রভাষক তাপস রশীদ নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, জিজ্ঞেস করতেন। তাদের কাছেও কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। মা-বাবার অনুপ্রেরণার পাশাপাশি শিক্ষকদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ আমার সাফল্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের ভালোবাসা ও স্নেহ সব সময় আমাকে সাহস জুগিয়েছে। লক্ষ্যে স্থির থাকলে এবং সঠিক পরিকল্পনায় আন্তরিকভাবে পড়াশোনা করলে সাফল্য নিশ্চিত। দারিদ্র্য কিংবা অন্য সমস্যা তাকে স্থির লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।

পূর্বকোণ / আরআর/পারভেজ

শেয়ার করুন