চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

হোমস্কুলিং বা গৃহশিক্ষা

বোকামি সমর্থন ও আগ্রহের বিবেচনা

সত্যজিত দাশ গুপ্ত

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আমাদের শিশুদের শিক্ষা ও তার
মানসিক বিকাশের জন্য পিতা-মাতার উদিগ্নতার শেষ নেই। কিন্তু উদ্বিগ্নতা
সুশিক্ষার সমাধান নয়। শিশুর মানসিক বিকাশে প্রয়োজন সূক্ষ্ম দর্শন আর নীরবে তাকে শিক্ষার প্রতি আগহী করে তোলা। যেমন ধরুন মোবাইল ট্যাব সেভ করা গেমগুলো আপানার শিশুর আগ্রহের প্রাণবিন্দু, কারণ এ নয় যে সে সেটা খুব পছন্দ করে। কারণ এটা যে সেটাতে তার আগ্রহ জন্মিয়েছে। গেম খেলতে খেলতে হঠাৎ বাসায় আরেকটি শিশু প্রবেশ করলে আপনার শিশুর গেম এর প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এরপর দেখা যায় তারা দুজন খেলায় মেতেছে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় আপানার শিশুর ব্রেণে আগহ তৈরি করা। যে পরিবারে মোবাইল ট্যাব নেই সেই পরিবারের শিশুটির আগ্রহ নিশ্চয় ভিডিও গেম নয়, অন্য কিছু। সুতরাং আপনি কিসে তাকে আগ্রহী করে তুলছেন আর তার আগ্রহকে আপনি কিভাবে সমর্থন করছেন এটার উপর আপনার শিশুর মেধা বিকাশ নির্ভর করে। এবার আসা যাক হোমস্কুলিং বা গৃহ শিক্ষা নিয়ে। হোমস্কুলিং বা গৃহশিক্ষা হল একজন গৃহ শিক্ষক বা পিতা/মাতার অধিনে সন্তানকে শিক্ষা দান করা। সেটি বাসা বা ভিন্ন স্থান বা অনলাইনেও হতে পারে। আমাদের দেশে একটা প্রবণতা আছে যে শিশু অ,আ,ক,খ লিখতে পারলে তাকে স্কুলে ভর্তি করানো উচিত। এবং তাই করা হয় বাকিটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কাজ। এরপর স্কুলের ড্রয়িং খাতায় যা আঁকাতে বলে হয়েছে পরিবারগুলো তা নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে উঠেন! শিশু শিক্ষার উদ্দেশ্য এ নয় যে তাকে যেটা দেওয়া হয়েছে সেটাই পারতে হবে। কারণ অপরিণত বয়সে সেটা তার জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে আর এতে করে তার আগ্রহ চিরতরে সে বিষয়ের জন্য মাটি হয়ে যেতে পারে। তাই হোম স্কুলিং প্রচুর
জনপ্রিয়তা পেয়েছে কারণ এ ব্যবস্থায় একজন শিশুকে তার পাঠদান থেকেও তার আগ্রহ, রুচিবোধ, স্তর বিবেচনা করে তাকে পাঠদান করা হয়। স্কুলের ধর্মীয় ও নীতিশিক্ষা, পরিবেশ, পাঠদান ব্যবস্থা, স্কুল সিলেবাস অনেক পিতামাতার অপছন্দের কারণে এ শিক্ষা ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন বলতে শোনা যায় আমার ছেলেটা স্কুলে গিয়ে মারামারি শিখেছে, আমার মেয়েটা কেমন জানি হয়ে গেছে। এই ছোটখাটো অভিযোগগুলো হরহামেশা শোনা গেলেও আমার কয়জনই এটা গুরুত্ত্বের সাথে বিবেচনা করছি! ১৯৬০-৭০ এর দিকে জন হল্ট, ডরথি, রেমন্ড মুর এর মত জনপ্রিয় লেখক ও গবেষকগণ যখন শিক্ষার পুন-জাগরণ নিয়ে লেখা শুরু করেন তখন থেকেই বিশ্ব শিশু শিক্ষার নতুন পরিবেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করে আর তা হল, হোম স্কুলিং বা গৃহশিক্ষা। এখানে শিশুর বোকামিকে সমর্থন, আগ্রহের বিবেচনা, পরিবেশের সাথে বৈচিত্রতা, পাঠদানের বিচিত্রতা, মানিসিক বিকাশকে বিবেচনা করে তাকে শিক্ষা দেওয়া হয়। জন হল্ট পিতামাতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘পাঠক্রমে আপানার শিশুকে উপযুক্ত না করে পাঠ্যক্রমকে তাহার উপযুক্ত করুন।’ এই ভিন্নধরনের কথাটা আমাদের শুনতে অনেকটাই উদ্ভট লাগে হয়ত। আমাদের শিশুকে আমরা নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত করি আর তা করতে না পারলে তাকে বকাঝকা করি আর তা নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বও হয় হরহামেশা। আমির খান অভিনিত “তারে জামিন পার” সিনেমায় দেখা যায় তিনি একটা শিশুর হাতে তার আঙ্গুলের স্পর্শের অনুভূতি দিয়ে অক্ষর জ্ঞান দিচ্ছেন। পরে বালিতেও রঙ তুলি দিয়ে এ বি সি ডি অক্ষর কিভাবে লেখা হয় তা শিখাচ্ছেন। কিন্তু শিশুটির পিতামাতা এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অক্ষর লিখতে না পারা শিশুটি কিন্তু দারুণ ড্রইং পারতো। আর জানেন তো কল্পনাবোধ ছাড়া ড্রয়িং হয় না। হোম-স্কুলিং আপনার শিশুকে পরিপূর্ণ বিকাশে পরিপূর্ণ সহায়তা করে বলে অনেকেই মনে করেন। এর সুফল অনেক সুদূরপ্রসারী। আমাদের দেশে এ শিক্ষা ব্যবস্থার গহণ যোগ্যতা এখনও তেমন সমর্থিত বা কাঠামোবদ্ধ নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা নয় এমন ঘোষণা দিয়েছেন। এত অল্প বয়সে শিশুকে পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে বিবেচনা করে পরিবার অনেক সময় শিশুর মেধা বিকাশ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু হোমস্কুলিং এর মাধ্যমে আপনি তার বিকাশকে আরও তরান্বিত করতে পারেন। বিল গেটস, মার্ক জুকারবাগ এর মত ব্যাক্তিরা স্বশিক্ষাকে প্রাধান্য দেন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা
প্রচলিত হলেও অনেক দেশে এখন এ শিক্ষার বৈধতা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সেরা বিকল্প এ ধারা আমাদের দেশেও অপ্রচলিত। যদিও সারা বিশ্বে দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইসরাইল, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে সরকারি শিক্ষার বিকল্প হিসেবে এ শিক্ষা জনপ্রিয়তা ও বৈধতা পেয়েছে। আসল উদ্দ্যেশ্যটা শিশুর মেধা বিকাশ আর তাদের জন্য সুন্দর আগামী তৈরী করা আর তারা যেন একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে পারে তার আগামীকে সে জন্য তাদের প্রস্তুত করা। তাই সন্তানের সাথে থাকুন আর তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। খেয়াল করুন সে কিসে আসক্ত, কিসে বিরক্ত, কোথায় আগ্রহ, কোথায় অনাগ্রহ? আর শিশুর বিরক্তিতে আপনি যেন বিরক্ত হয়ে না উঠেন সেদিকে অবশ্য নিজের খেয়াল রাখবেন। পরিবার শিক্ষা একটি শিশুর ভিত মজবুত করতে সব থেকে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তাকে স্ব-শিক্ষিত করে গড়ে তোলার অভ্যাস করান। কারণ জ্ঞান আহরণ তার আগহের বিষয়ে পরিণত হলে শিক্ষা লাভ তার জন্য বোঝা নয় বরং আনন্দের হয়ে উঠবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট