চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মুজিববর্ষেই হোক প্রতিটি নাগরিকের নবজাগরণ

সঞ্জয় চৌধুরী

২৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:১৬ পূর্বাহ্ণ

কালের পরিক্রমায় দিনে পর আসে মাস, মাসের পর আসে বছর, বছরের পর আসে যুগ আর যুগের পর আসে এক একটি শতাব্দী। এভাবে এক একটি শতাব্দী আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে মহাকালের অতল গহ্বরে। এতগুলো শতাব্দী হারিয়ে গেলেও আমাদের থেকে হারিয়ে যায়নি ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি দিন ১৭ মার্চ ১৯২০। সে দিনে জন্মগ্রহণ করেছেন বাঙালীর হাজারো বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দিনটির শতবর্ষ পরের বছরটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বরণ করার জন্য সমগ্র জাতি আজ অধীর আগ্রহে উদ্বেলিত। উদ্বেলিত এই জাতির জন্য বিশেষভাবে বরণীয় এই বছরটি হল ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কালীন গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকো। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে পূর্ণ হবে বাংলাদেশর স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের শত বছর। আর ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে যেমন বঙ্গবন্ধুকে চিন্তা করা যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিলে অর্থহীন হয়ে পড়ে বাংলাদেশও। আগামী ১৭ মার্চ ২০২০ রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছরব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন হবে। মুজিব বর্ষের প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সারাদেশে সকল জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে জাতীয়ভাবে ও দলীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হবে।

এছাড়াও বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে মুজিববর্ষ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো। এখন শুধু বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই নয়, বছরব্যাপী নানা আয়োজনে মুজিববর্ষ উদযাপিত হবে বিশ্বের ১৯৫টি দেশেও। আর ইউনেস্কো কর্তৃক এই আয়োজনে যুক্ত হওয়ায় সুযোগ সৃষ্টি হলো আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশ্বনেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন আরো ব্যাপক পরিসারে ছড়িয়ে দেওয়ার।

আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, সর্বোপরি সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ৭ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। যা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক চির অম্লান মাইলফলক হিসেবে স্বাক্ষর বহন করেছে। তার বলিষ্ঠ সুযোগ্য সুদৃঢ় অনমনীয় অকুতোভয়, সর্বোপরি দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে পৌছে দিয়েছেন স্বাধীনতার সুবর্ণ তোরণে। জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে এ দেশের মানুষের জন্যই কষ্ট স্বীকার করে গেছেন জাতির পিতা।

আর সেই কষ্টের ফসল হিসেবেই আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা ও স্বাধীন জাতির মর্যাদা। আমি মনে করি এই মুজিববর্ষ উদযাপন নতুন প্রজন্মকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে অনুপ্রাণিত করবে এবং দেশ সেবায় আতœনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য অপার সম্ভাবনাময় নতুন প্রজন্মের শ্রম, মেধা, জ্ঞান ও মননকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ ও জাতি গঠনের সৎ কর্মযজ্ঞে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষায় অগ্রসরতা ও খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যে বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এছাড়াও ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে শুধু আশ্রয়ই নয়, প্রতিদিন তাদের খাওয়া দাওয়া, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রীর ব্যবস্থা করে এই দেশ বিশ্বমানবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। আমরা আশা করি আগামী ২০২১ সালে আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। সেই পথে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পা রেখেছে উন্নয়নের মহাসড়কে ডিজিটাল দেশের কাতারে সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে ডাবল ডিজিট গ্রোথের দিকে। দরিদ্রতা নেমে এসেছে মাত্র ১৮ শতাংশে, মাথাপিছু আয় বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে।

নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। বাস্তবায়িত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্ততঃ ১০টি মেঘাপ্রকল্প। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথ ঘিরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মূল্যায়নে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার অর্থনীতিতে নতুন ইমার্জিং টাইগার, যা অনুসরণীয় হতে পারে অন্যান্য দেশের। আসলেই জাতির জনকের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একটি সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন এবং ভালবেসে সেই সোনার বাংলার স্বপ্নকে তাঁর দেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করেছিলেন। আজ শেখ মুজিবের সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাদার অব হিউমিনিটি দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা। সোনার বাংলা এখন অনেকাংশে দৃশ্যমান বাস্তবতা। তাই মুজিব বর্ষ পালনের প্রাক্কালে জাতির জনকের এই জন্মশতবার্ষিকীতে বাঙালি হিসেবে আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাচ্ছি। মুজিববর্ষ পালন করার এ সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকারের অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। আমি মনে করি জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী পালনের এই মাহেন্দ্রক্ষণেই তাঁর জীবনী নতুন করে চর্চা করার সময় এসেছে। তাঁর প্রজ্জ্বলিত দীপ্ত শিখা তথা সমুজ্জল আলো ছড়িয়ে পড়–ক বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে, মাঠ-ঘাট প্রান্তরে, আকাশে বাতাসে সর্বত্র এই হোক আমাদের প্রত্যাশা। জাতির জনকের এই জন্মশতবার্ষিকীতে সব ভেদাভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সবাইকে দিনবদলের সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক ও সহিষ্ণু সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে নব জাগরণ সৃষ্টি করি। মুজিববর্ষকে সামনে রেখে যদি এই ধরনের নবজাগরণ সৃষ্টি করা যায়, তবে বর্ষটি পালন জাতীয় জীবনে সফল ও সার্থক হয়ে উঠবে।

সঞ্জয় চৌধুরী শিক্ষক ও কলামিষ্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট