চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

২৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বে মানবাধিকার আজ লঙ্ঘিত, বঞ্চিত, জর্জরিত-মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মানবাধিকার সংগঠন গুলো। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, রেহাই পাচ্ছে না নিরপরাধ শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলা। বিভিন্ন প্রান্তর আর জনপদে বয়ে যাচ্ছে রক্তের বন্যা। সিরিয়া, ইরাক, কাশ্মীর, মিয়ানমারসহ অনেক দেশে মুসলিম নিরপরাধ মানুষদের পাখির মত গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে ১০ লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে আমাদের দেশে। বিশ্বে মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হিসাবে খ্যাত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশগুলোতে শান্তির ছিটেফোঁটাও দিতে পারেনি। শুধু ভাষণ আর বুলি আওড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিজেদের মানবাধিকারের মূল হোতা হিসাবে জাহির করে, কিন্তু ১৪শ’ বছর আগে বিদায় হজ্বের ভাষণে মানবতার মহান শিক্ষক, বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, খাতেমুন নাবিয়্যিন, সাইয়্যেদিল মুরসালিন, ইমামুল আম্বিয়া, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও রাসূল ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে প্রদত্ত বিদায় হজ্বের ভাষণে বিশ^বাপী মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য তারও আগে মদিনা রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে সব মতের মানুষদের মাঝে মানবাধিকারের সূচনা করেছিলেন তিনি।
১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের ঘোষণা বর্তমানে প্রচলিত মানবাধিকারের মূলনীতি হিসাবে গণ্য করা হলেও ১৪শ’ বছর পূর্বে ইসলাম মানবাধিকারের রুপরেখা ঘোষণা করেছিল।

উক্ত দু’টি দেশের স্বাধীনতা সনদের ঘোষণাসমূহ বিশ্ব মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রদত্ত বিদায় হজ্বের ভাষণের যেন হুবহু ফটোকপি। জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার নীতি ঘোষণা করে ১৯৪৮ সালে, যা ৬১০ সালেই আমাদের রাসূল (সা.) জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষদের জন্য আরবের মরু প্রান্তরে ঘোষণা করেছিলেন। মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে বিশ্ব মানবাধিকারের প্রবক্তা বলা হয়-তাঁর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ মাইকেল এইচ হার্ট, যিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য দার্শনিক- তিনি একটি বই লিখেছেন, বইটির নাম ঞযব যঁহফবৎফং। বইটিতে জধহশরহম ড়ভ ঃযব সড়ংঃ রহভষঁবহঃরধষ ঢ়বৎংড়হধষরঃরবং রহ ঃযব ড়িৎষফ -এ বিশ্বনবীর নাম সর্বাগ্রে স্থান পেয়েছে। বিগত শতাব্দির মাঝামাঝি জাতিসংঘ তার একটি সম্মেলনে যুদ্ধবন্দীদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে যা প্রায় ১৪শ’ বছর পূর্বে ৬২৪ সালে রাসূল (সা.) বদরের যুদ্ধবন্দীদের প্রদান করে গেছেন।
সপ্তদশ শতাব্দিতে যখন ইউরোপীয় শক্তি লক্ষ লক্ষ মানবসন্তানকে আফ্রিকা মহাদেশে শৃঙ্খলিত দাসে পরিণত করেছিল এবং খোলা বাজারে পশুর ন্যায় কেনাবেচা করছিল তখন থেকে ১০০০ বছর পূর্বে ইসলাম দাস প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করেছিল। ১৮৩৫ সালে মার্কিন মেয়েরা তাদের জন্য প্রথম স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় আর অন্যদিকে ইসলাম ১৪০০ বছর আগেই মেয়েদের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে। ১৮৪৮ সালে মার্কিন মেয়েরা সম্পত্তি ভোগের অধিকার লাভ করে আর ইসলাম তার শুরুতেই এ অধিকার দিয়ে দেয়। ১৯২০ সালে মার্কিন মেয়েরা ভোটাধিকার লাভ করে আর মুসলিম মেয়েরা এ অধিকার পেয়েছে পুরুষদের সাথে সাথেই। ইংল্যান্ড এর ম্যাগনাকার্টা, পিটিশন অব রাইটস, বিল অব রাইটস, আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা, ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণা, ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের মূল নিয়ন্ত্রক বলা হয়ে থাকে। মহানবী (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণের মাধ্যমে মানবাধিকারের যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছেন তার হুবহু ব্লু প্রিন্ট উপরোক্ত মানবাধিকার সংগঠনসমূহের মূল সনদের সাথে মিলে যায়। আমার রাসূল (সা.) তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণে দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন যে, ‘হে লোক সকল, তোমাদের জান-মাল ও ইজ্জত আব্রুর উপর হস্তক্ষেপ তোমাদের উপর হারাম করা হলো।’

আরেকটি হাদিসে তিনি বলেন, ‘কোন মুসলিম ব্যক্তির নিহত হওয়ার তুলনায় সমগ্র পৃথিবীর পতন আল্লাহর দৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ ব্যাপার।’ ইসলাম জীবনের নিরাপত্তার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘কোনো মানুষকে হত্যা করা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ (করার শাস্তি প্রদান) ছাড়া (অন্য কোনো কারণে) কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করলো, (আবার এমনিভাবে) যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে তবে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো’- সূরা মায়েদা- ৩২। ইয়াতিমের সম্পদের উপর সর্বোচ্চ অধিকার দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ইয়াতিমদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছু ঢুকায় না। অচিরেই তারা জাহান্নামে জ্বলবে।’ হযরত আবু হুরাইরা বর্ণনা করেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা কিছু লোককে এমন অবস্থায় কবর থেকে উঠাবেন যে, তাদের পেট থেকে আগুন বের হবে এবং মুখ থেকে আগুনের উদ্গিরণ হবে।’ জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হে রাসূল (সা.) এর কারা? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহতায়ালার এ কথাটি তুমি পড়নি যে, যারা ইয়াতিমদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ভক্ষণ করে না।’

ইসলাম মানবাধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নির্দেশনা দিয়েছে প্রচুর। এতে রয়েছে-সম্পত্তির অধিকার, স্বাধীনভাবে ধর্ম বিশ্বাসের অধিকার, মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার, বন্দিদের প্রতি ন্যায়বিচারের অধিকার, ভ্রাতৃত্বের অধিকার ও ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা ইত্যাদি। বিদায় হজ্বের ভাষণে মহানবীর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ‘আরব-অনারব, সাদা-কালো তে কোন ভেদাভেদ নেই, নেই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য। তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরি।’ ইসলাম মানবাধিকারের গোড়াপত্তন করেছে-এটা এখন সারা বিশ্ববাসীর কাছে ওপেন সিক্রেট। সারা বিশ্বে অসহায় মানবতার রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে অসংখ্য রাজপথ ও জনপদ কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, বিশ্ব মোড়লরা আজ মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো মিড়িয়াতে বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সরব শুধু ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে। বিশ্বনবীর বিদায় হজ্বের ভাষণ থেকে মানবাধিকারের যে মূলমন্ত্রগুলো পাশ্চাত্য শক্তি তাদের স্বাধীনতা সনদে গ্রোথিত করেছে তার ছিটে-ফোঁটাও যদি বর্তমানকালে মহাদুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলেই রক্ত¯œাত এই বিশ্ব পেত এক সুন্দর সবুজ পুষ্পময় বাগিচা। আর শান্তির আবাহনে মাতোয়ারা হয়ে উঠত পুরো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সভাপতি, রাউজান ক্লাব, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি ফৎড়সধৎভধৎড়ড়শ@মসধরষ.পড়স

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট