চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা

আবদুল্লাহ আল মাউন

২৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ

কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেবল ঐ দেশের অর্থনৈতিক উপাদানের উপর নির্ভর করে না। মানবিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এমনকি অর্থনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের স্বচ্ছতার মত অ-অর্থনৈতিক উপাদানের উপরও নির্ভর করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মানুষকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বিনিয়োগ করতে নানামুখী উৎসাহ সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিমুক্ত হন তখন গ্রাহকরা প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগের ফলে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, বেকারত্ব হ্রাস পায়, সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটে থাকে। উল্টোদিকে যদি আর্থিকখাতে দুর্নীতি বাড়তে থাকে এবং স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয় তবে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যায় এবং অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের বেতন-ভাতাদী পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। ফলে শ্রমিকদের মাঝে অস্থিরতা দেখা দেয় এমনকি তাঁরা আন্দোলন-বিক্ষোভের মাধ্যমে তাঁদের পাওনা আদায়ের চেষ্টা করে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তখন শ্রমিক ছাটাইয়ের মত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে ২০১৪ সালের পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই বললেই চলে। মাঠে-ঘাটে কোনো আন্দোলন নেই তবুও অর্থনীতির নিম্নমুখী সূচকের খবর শুনতে পাই কেবল আর্থিকখাতে অর্থ ক্যালেঙ্কারীর মত দুর্নীতির কারণে। শেয়ার বাজারে মানুষ বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে এখন। দেশের শেয়ার বাজারের খবর মোটেও চাঙ্গা নয় বর্তমানে।

দেশের ব্যাংকিংখাত মোটেও ভাল নেই। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। খেলাপী ঋণ, ফোর্সড লোন, একের পর এক ঋণ জালিয়তিতে ভেঙ্গে পড়ছে ব্যাংকিংব্যাবস্থা। আমরা সবচেয়ে বেশী আতঙ্কিত হই বর্তমানে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দেখলে। কেবল গত নয় মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশের খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। খেলাপী ঋণের পরিমাণ কমাতে সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকলেও ঋণের পরিমাণ কমেনি বরং বেড়েই চলছে। এক হিসেবে জানা যায়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এছাড়া ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা অবলোপিত ব্যয় হিসেবে ধরা হয়েছে। যা মোট খেলাপী ঋণের হিসেবের বাইরে। যদি এই অবলোপিত টাকাসহ হিসেব করা হয় তাহলে মোট ঋণখেলাপী টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশী। যা আমাদের বাজেটের প্রায় ৩৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা ডাবল ডিজিট সুদের হারকে ঋণখেলাপী বাড়ার মূল কারণ হিসেবে দায়ী করছেন। আবার অনেক মনে করেন রাজনৈতিক যোগসাজেশ, ক্ষমতার অপব্যবহার এমনকি ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে সরকারের নমনীয়তাকে দায়ী করছেন। জানা গেছে, সরকার বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীকে সিঙ্গেল ডিজিট (সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ ) হারে ঋণের অনুমোদন দিচ্ছে। যেসব শিল্পগোষ্ঠীর বিনিয়োগ অর্থনীতি সরাসরি প্রভাব ফেলবে কেবল তাঁরাই এই ঝণের সুযোগ নিতে পারবে। আমরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। কেননা সুদের হার কম হলে শিল্পগোষ্ঠীরা ঋণের চাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে। আবার তাঁরা যেন সিঙ্গেল ডিজিট ঋণের সুবিধা নিয়ে অন্য খাতে কাজে না লাগায় সে দিকে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এক খাতের জন্য ঋণ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার মত কর্মকা- আমরা অতীত লক্ষ করেছি ।

ঋণখেলাপী ছাড়াও কিছু চৌকস ব্যাক্তি ফোর্সড লোনের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন ব্যাংকের টাকা। পণ্য আমদানী রপ্তানীর সময় যে ঋণপত্র খোলা হয় বিদেশী কোম্পানিকে তাঁর গ্যারান্টি দিয়ে থাকে দেশী ব্যাংকগুলো। দেশে আমদানী করা পণ্য আসার পর শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক দেশী ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশী ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করে থাকে । কিন্ত কোনো কারণে গ্রাহক টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী যেই ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ঐ ব্যাংকে গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন খোলা হয় এবং বিদেশী ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করা হয়। মূলত আমদানীর জন্যই ফোর্সড লোন খোলা হয়ে থাকে। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ৪ টি ব্যাংকে গত জুন পর্যন্ত ফোর্সড লোনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশী ফোর্সড লোন দিয়েছে জনতা ব্যাংক ৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী দরপত্র খোলার সময় গ্রাহক সম্পর্কে অধিকতর যাচাই বাচাই করার কথা। যদি অধিকতর যাচাই বাচাই করা হতো তাহলে অর্থনীতির এই রক্তকরণ হতো না । আমরা আশা করি দেশের ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাতে ভবিষ্যতে ঋণপত্র খোলার ব্যাপারে ব্যাংকগুলো তাঁদের উদাসীনতা থেকে বেরিয়ে আসবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট