চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুস্থ জাতি গড়তে চাই জোরদার তামাকবিরোধী প্রচারণা

জেসমিন সুলতানা পারু

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

এ যেন আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে চলছে সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি ও বিজ্ঞাপন। গত বছর ১২ ডিসেম্বর এ আদেশ জারি করা হয় এবং গত ৮ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। একই সাথে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় এই বিষয়ে। এরপরও তামাক কোম্পানির দৌরাত্ম্য যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। নির্দেশনা কিংবা ২০০৫ সালে এবং ২০১৩ সালে (সংশোধিত) তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনসহ বিভিন্ন উদ্যোগও একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে কি বলতে হবে তামাকজাত কোম্পানিগুলো আইনের চেয়েও শক্তিশালী? নাকি উদ্যোগ গ্রহণের পর তা বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব? যার কারণে উৎসাহের সাথে শুরু করা পরিকল্পনা কিছুদিন পর আবার মুখ থুবড়ে পড়ে? নাকি অপর্যাপ্ত তদারকির কারণে গজিয়ে উঠা আগাছার শেকড় উপড়ে নেওয়ার পড়েও আবার নতুন করে গজিয়ে উঠে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ এসব প্রশ্নের উত্তরেই থাকবে নতুন প্রজন্মের জন্য সুশৃঙ্খল জীবনের সমাধান, থাকবে কেমন ভবিষ্যৎ আমরা তাদের সামনে রাখতে চাই তার উত্তর। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নেওয়া একটি উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসা লাভ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ গজের মধ্যে তামাকজাত পণ্যের বিক্রি বিতরণ নিষিদ্ধ করার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক সমাজ। ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একশ গজের মধ্যে তামাকজাতপণ্যের দোকান অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘এতদ্বারা সব তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, চট্টগ্রাম মহানগরীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে কোনো প্রকার তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়, বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালানো যাবে না। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (২০১৩ সালের সংশোধনীসহ) এর বিধানমতে এসব কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এর মধ্যে সব তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়, বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা বন্ধ করার নিদের্শ দেয়া গেল। অন্যথায় উল্লেখিত তারিখের পর কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেল/জরিমানাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে সবার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি।’
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কড়া হুশিয়ারিসহ বন্ধের সর্বাত্মক নির্দেশ থাকলেও বন্ধ হয়নি তামাকজাত পণ্যের বিক্রি, প্রদর্শন ও বিতরণ। দেখা গেছে তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন মাধ্যমে পরোক্ষ তামাক/সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে বিটার তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রমোশনের উপর চালানো একটা জরিপে দেখা গেছে পোস্টার/সাইন বোর্ড, স্টিকার, ব্যানারের মাধ্যমে ৭৫.৭৬ শতাংশ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ডামি প্যাকেট, খালি প্যাকেট দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হয় ৬৩.০৮ শতাংশ। ৫৫.৭৪ শতাংশ তামাকপণ্য বিক্রয়ের বক্স, শোকেজ। বিভিন্ন কাঠামোর উপর তামাক ব্র্যান্ডের ছাপ দিয়ে ৪৩.৭৩ শতাংশ, ডিসকাউন্ট/ কুপন, ফ্লাইয়ার/লিফলেট /পেম্পলেটের মাধ্যমে যথাক্রমে ৩.৩১ এবং ৩.০৮ শতাংশ বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, প্রচার প্রসার করা হয়ে থাকে। যেখানে এইসব বিজ্ঞাপনের প্রচারে দেশে শাস্তিমূলক আইনের উল্লেখ আছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫নং ধারার ১নং উপধারায় বলা আছে ‘কোন ব্যক্তি প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোনভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না।’ এবং ৫নং ধারার ৪ নং উপধারায় বলা আছে, কোন ব্যক্তি এই ধারার বিধান লংঘন করিলে তিন মাস পর্যন্ত কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন’।

তবে তামাকমুক্ত চট্টগ্রাম নগরী গড়তে সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশন একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ওয়ার্কিং কমিটিতে রয়েছে। এখানে ওয়ার্কিং কমিটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ধারা ৫ এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, তামাক কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ গজের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। ট্রেড লাইন্সেসের আওতায় আনা, ট্রেড লাইন্সেস নবায়ন ও প্রদানের ক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা গ্রহণ করা উল্লেখ্যযোগ্য। এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে। পাশাপাশি তামাকমুক্ত চট্টগ্রাম নগরী গড়তে জনসম্পৃক্ততা তৈরিতে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিটা, ক্যাব ও ইলমা। এই সাংস্কৃতিক কার্যক্রম মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরিতে সাহায্য করবে নিশ্চয়ই।

বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেখানে তামাক ব্যবহার রোধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে, সেখানে লক্ষ্য স্থির করার পরেও আমাদের এভাবে পিছিয়ে থাকা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার। কিন্তু ঘোষণা দেওয়ার পরেও তামাক ব্যবহার রোধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা যেন অংকুরেই বিনষ্ট হচ্ছে যথাযথ তদারকির অভাবে। যার ফলস্বরূপ তামাক কোম্পানিগুলো অনেকটা স্বস্থির সাথেই ধূমপান ও তামাকের প্রসারের যত যা করা সম্ভব তাই করছে। তামাক কোম্পানির কূটকৌশলের কাছে যেন জিম্মি হয়ে আছে সব কিছু।
ধূমপায়ীর দিক দিয়ে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১ তম, যেখানে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে। এমন উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান ও আশংকার মধ্যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই পারে নতুন প্রজন্মকে আশ্বস্থ করতে, যেখানে বিষাক্ত নিঃশ্বাসের নীল বিষে হৃদয় পুড়ে না। বিষাক্ত ধোঁয়ার করাল গ্রাসে হ্রাস পায় না প্রাণশক্তি।

জেসমিন সুলতানা পারু, প্রধান নির্বাহী, ইলমা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট