চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আদম-হাওয়া’র (আ.) বংশধর ও তাদের জীবন-জীবিকা

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর প্রথম মানব নবী হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করে যথাযথ মর্যাদা দানপূর্বক আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে রাখে। কিছুদিন তিনি একাকীই ছিলেন সেখানে। অতপর পরওয়ার দিগার আল্লাহ তায়ালা আদমের সঙ্গী হিসেবে হাওয়াকে (আ.) সৃষ্টি করলেন এবং উভয়কে বেহেস্তে বসবাসের আদেশ দিয়ে বললেন যে, এখানে তোমার যা ইচ্ছে ভোজন ও পান করবে, কিন্তু কদাচ একটি নির্দিষ্ট বৃক্ষের নিকটবর্তী হবেনা। অনেকদিন ধরে অনাবিল সুখ-শান্তির মধ্যে আদম-হাওয়া (আ.) বেহেস্তে অবস্থান করেন এবং নিষিদ্ধ বৃক্ষের গাছ থেকে দূরে থাকেন।

কিন্তু আদমের সুখ-শান্তি দর্শনে ইবলিশ ঈর্ষানলে দগ্ধ হয়ে তাদেরকে জান্নাত থেকে বহিস্কার করার জন্য নানা মূর্তিতে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ঐ নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়াতে প্ররোচিত করে। শয়তানের দীর্ঘ দিনের চেষ্টার ফলে বিবি হাওয়া প্রথমে শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হন। তিনি শয়তানের প্ররোচনায় ঐ বৃক্ষের ফল আহরণ করে প্রথমে স্বয়ং ভক্ষণ করেন এবং পরে হযরত আদমকে খেতে অনুরোধ ও প্রলুব্ধ করেন।-(অবশ্য এ কথা কুরআনে নেই, বাইবেলের)। হযরত আদম প্রথমে অস্বীকৃত হলেও অবশেষে আদেশ বিস্মৃত ও হতবুদ্ধি হয়ে ঐ ফল ভক্ষণ করেন।
ফলে তাদের অঙ্গ হতে বেহেস্তী পোষাক অপসৃত হতে থাকে। তারা লজ্জিত ও সংকোচিত হয়ে বৃক্ষপত্রে অঙ্গ আচ্ছাদন করেন। অত:পর আদম আল্লাহর দরবারে অপরাধ স্বীকার করেন। তাওবা করে নিজের অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করলেন এবং সাথে সাথে এও অবহিত করলেন যে, তোমার বংশধরদেরকে সামান্য সময়ের জন্য দুনিয়ায় অবস্থান করতে হবে। ঐ সময়ে যারা আমার দেয়া বিধান মুতাবিক জীবন যাপন করবে তাদের কোন ভয়ের কারণ নেই।-(দ্র. সূরা বাকারা ৩৫-৩৯, আরাফ ১৯-২৫, ত্বাহা ১১৫-১২৩)।

উল্লেখ্য, আল্লাহতায়ালার আদেশ বিস্মৃত হয়ে শয়তানের প্রবঞ্চনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার দরুন হযরত আদম-হাওয়া তখনই বেহেস্ত হতে বিতাড়িত হয়ে ধরাতলে নিক্ষিপ্ত হন। কথিত আছে যে, হযরত আদম সিংহলে (ভারতবর্ষে) এবং হাওয়া ইয়ামেন প্রদেশে নির্বাসিত হয়েছিলেন। (আনোয়ারুল আম্বিয়া-১১, ইফা)। সাধারণ বর্ণনা মতে, আদম (আ.) সারণদ্বীপ (শ্রীলংকা), হাওয়া জিদ্দায় আপাতত হয়েছিলেন এবং আরাফাতের ময়দানে আবার উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটেছিল।
আদম যে দ্বীপে অবতরণ করেছিলেন ঐ দ্বীপে একটি পর্বত আছে। পর্তুগীজরা এর নাম দেয় পিকে ডি আদাম বা আদমের পর্বত। বর্তমান শ্রীলংকায় এটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থানও বটে। উপাখ্যান অনুযায়ী সেখানে একটি পাথরে আদমের ৭০ ফুট দীর্ঘ পদচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।-(ই, বিশ্বকোষ ১/২৪৩)।
অনন্তর হযরত আদম বহুদিন পর্যন্ত কারো কারো মতে প্রায় দু’শত বছর অনুতপ্ত ও দুঃখবিগলিত চিত্তে স্বীয় দোষত্রুটির জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহর অসীম করুণায় তাদের ক্ষমা করেছেন। তারপর প্রিয়তম পতœী বিবি হাওয়ার সাথে সুখে-দুঃখে সংসার জীবন অতিবাহিত করেন।
পূর্বে ধারণা এই ছিল যে, আদম আরবী ভাষায় কথা বলতেন। ঐতিহাসিক হালাবীর মতে, আদম জান্নাতে আরবী ভাষায় কথা বলতেন কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর তিনি সিরিয় ভাষায় কথা বলতেন। ইহুদী উপাখ্যান অনুযায়ী তাকে আগুনের ব্যবহার, কৃষিকাজ এবং কুটির শিল্প শিক্ষা দেয়া হয়।-(তাবারী ১/১২৩)।
ইমাম কুরতুবী উল্লেখ করেন যে, আদম যখন পৃথিবীতে অবতরণ করলেন তখন জিব্রাইল (আ.) জান্নাত থেকে কিছু গম, চাউল ইত্যাদির বীজ এনে মাটিতে চাষ করার জন্য দিলেন এবং বললেন: যখন এগুলোর চারা গজাবে এবং দানা উৎপন্ন হবে তখন এগুলো কর্তন করুন এবং পিষে রুটি তৈরী করুন। ফেরেস্তা এসব কাজের পদ্ধতিও প্রথম মানবকে বাতলে দেন।

সে মতে আদম রুটি তৈরী করে খেতে বসলেন। কিন্তু হাত থেকে রুটি খসে গিয়ে পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে গেল। আদম বহুত পরিশ্রমের পর রুটি কুড়িয়ে আনেন। তখন জিব্রাইল বললেন হে আদম, আপনার এবং আপনার সন্তান-সন্ততির রিজিক পৃথিবীতে এমনি পরিশ্রম ও কষ্টসহকারে অর্জিত হবে।’-(মারেফুল কুরআন, অখ- ৮৬৭)।
ঐতিহাসিক ইবনুল আছীরের বর্ণনা মতে, আল্লাহ আদমকে পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং জিব্রাইল (আ.) তাকে হজ্বের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেন। ঐতিহাসিক হালাবীর মতে, তিনি স্বাভাবিক জীবনের প্রয়োজনে দিরহাম এবং দিনার মুদ্রা ব্যবহার করতেন।
আদমের প্রথম সন্তান কাবিল, তৎপর হাবীল। প্রতিবার তাদের যমজ সন্তানের জন্ম হত- একটি পুত্র একটি কন্যা। আদম প্রত্যেক পুত্রের সাথে তার যমজ বোনের বিবাহ দিতেন। এক বর্ণনা মতে, আদম হাবীলের সাথে আকলিমা এবং কাবিলের সাথে ‘গাজের’ বিবাহ সম্পন্ন করতে আদিষ্ট হন। কিন্তু আকলিমা পরমা সুন্দরী ছিল, কাবিল তাকেই বিবাহ করার জন্য শক্ত জেদ ধরে। অনন্যোপায় হয়ে হযরত আদম উভয় পুত্রকে কুরবাণী প্রদান করতে আদেশ দেন। সে সাথে একথাও বলে দেন যে, যার কুরবাণী গৃহিত হবে সে-ই আকলিমাকে পতœী রূপে পাবে।

তাওরাতে বর্ণিত আছে যে, কাবিল কৃষি কাজ করত, হাবীল পশুপাল চরাতো। কাবিল উৎপাদি শস্য ও হাবীল কয়েকটা ছাগল কুরবাণী করেছিল। হাবীলের কুরবাণী আল্লাহতায়ালা কবুল করেন। তা দেখে কাবিল ক্রোধান্ধা হয়ে হাবীলকে হত্যা করে। (জন্ম পুস্তকঃ ৪/৩-৫ পংক্তি)। কাবিল নিহিত ভ্রাতার মৃত দেহ কিভাবে গোপন করবে, তা নিয়ে বিপাকে পড়ে। সে যখন এ বিষয়ে কিছুই ভেবে স্থির করতে পারল না আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে মৃতদেহ কবরস্থ করার প্রণালী শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে দু’টা কাক প্রেরণ করেন। কাক দু’টি হঠাৎ তুমুল ঝগড়ায় অবতীর্ণ হয়। এক পর্যায়ে একটি নিহত হয় । তখন হত্যাকারী কাকটি ঠোঁটে মাটি খুঁড়ে নিহিত কাকটিকে প্রোথিত করে উড়ে যায়। তা দেখে কাবীল লজ্জিত হল এবং শিক্ষা নিল। তার পর সেও মাটি খনন করে হাবীলের মৃতদেহ দাফন করলো। -(দ্র. সূরা মায়িদা ২৭-৩১)।
স্মরণযোগ্য যে, ইহুদী সাল অনুযায়ী ৬ নীসান শুক্রবার আদমকে সৃষ্টি করা হয়। একই দিনে তিনি জান্নাত হতে বহিস্কৃত হন এবং একই তারিখে তার মৃত্যু হয়। তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ের পাদদেশে রতœ গুহায় সমাহিত হন.(ইয়াকুবী ১/৫)। কোন কোন বর্ননায় রয়েছে হযরত আদম (আ.) হজ্ব পালন, বংশ বিস্তার সম্পন্ন করে আবার ভারত বর্ষে ফিরে আসেন। তবে কোন মাটিতে তিনি শুয়ে আছেন তা এখনো গবেষনাধীন রয়েছে। হযরত আদম প্রায় ৯৩০ বছর জীবিত ছিলেন।

তাঁর তৃতীয় পুত্রের নাম হযরত শীছ (আ.)। পিতার অবর্তমানে তিনি সত্য প্রচারে আতœনিয়োগ করেন। বাইবেলসহ বিভিন্ন গ্রন্থে আদমের (আ.) বংশধরদের একটি তালিকাও রয়েছে।-(দ্র. বাইবেল ৫ অধ্যায়, পঙক্তি ও আনোয়ারে আম্বিয়া-১৭)। আদম সন্তানদের এ দুনিয়াবী জীবন ক্ষণস্থায়ী। শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে এ জীবনকে সফল করে তোলে চিরস্থায়ী জান্নাতের জন্য সুখ-শান্তির ্প্রয়াসই হোক সকলের চুড়ান্ত লক্ষ্য।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট