চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

অব্যাহত পরিবেশদূষণ ও স্বাস্থ্যবান জাতির স্বপ্ন

আবু মোশাররফ রাসেল

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর বিখ্যাত ব্রাজিলের আমাজন বনের গাছ-গাছালি আর লতাগুল্মের গভীরতা এতই বেশি যে বলা হয়ে থাকে, ‘আমাজনের গহীনে গাছের পাতা ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছাতে পারে না।’ সূর্য উদিত হোক আর না হোক, বনের পরিবেশ থাকে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন।’ আমাজনের সেই পরিবেশের সাথে চট্টগ্রাম মহানগরীর কিছু কিছু এলাকার পরিবেশেরও দারুণ মিল দেখা যায়। এখানেও সূর্য উঠুক আর না উঠুক, চৈত্র্যের ফকফকা রোদের দিনেও পরিবেশ থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন, কনকনে শীতের ভোরের মতো কুয়াশার চাদরে ঢাকা। তবে এখানকার কারণটি ভিন্ন। আমাজনের গাছের ডাল-পাতা-লতাগুল্ম সেখানে সূর্যের আলোকে মাটিতে পৌঁছাতে বাধা দেয়, আর চট্টগ্রামে আগ্রাসী কিছু মানুষের স্থাপিত কলকারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ভেদ করে সূর্যের আলো সমতলে ঘেঁষতে পারে না। আমাজনের গাছের পাতা সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে প্রকৃতিকে সুরক্ষা দেয়, চট্টগ্রামের বিষাক্ত ধোঁয়ার সাথে সূর্যের রশ্মি মিলে তা আরও মারাত্মক বিধ্বংসী হয়ে প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে, বাতাসের বস্তুকণায় মিশে পুরো অঞ্চলের মানুষ ও প্রাণিদেহে তা ঢুকে পড়ছে।

নগরীর বায়েজিদ এলাকায় আপনি যে সময়েই যাবেন, দেখবেন বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আকাশ, দিনদুপুরে সেখানে নেমেছে রাতের অন্ধকার। রড উৎপাদনকারী মূলধারার প্রতিষ্ঠানের বাইরে এখানে গড়ে উঠেছে কিছু ‘অবৈধ কারখানা।’ এই কারখানাগুলো থেকে দিনরাত সব সময় বিষাক্ত কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। পরিবেশ দূষণরোধ করার কোনো ব্যবস্থা তারা রাখেনি, কারখানায় নেই কোনো বর্জ্য শোধনাগার, ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা ইটিপি। পুরো বায়েজিদ এলাকা তাদের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকে সব সময়। তাদের এই পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকা- চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই লেখালেখি হয়, পরিবেশবাদীদের বক্তৃতা-বিবৃতি চলে কিন্তু মালিকদের তাতে ‘কিছু যায় আসে না’

একই পরিস্থিতি কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়জুড়ে, দক্ষিণ পাড়ে এবং মইজ্যার টেক এলাকায়। কর্ণফুলীর উত্তরপাড়ের সদরঘাট এলাকায় ভোরে গেলে দেখা যায় দক্ষিণ পাড়ের আকাশ কলকারখানার কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে যে তথ্যটি জানা গেছে তা হলোÑকারখানার মালিকরা ইটিপি খরচ বাঁচাতে, ভোররাতের দিকে কারখানা পরিশোধন করতে কালো ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। এখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিও চলছে দীর্ঘদিন ধরেই।
শুধু বায়ু দূষণই শেষ কথা নয়; নদীর পানি, চাষের জমি থেকে সবকিছুই নানাভাবে ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। পাহাড়-নদী-সমুদ্র ঘেঁষা অপরূপ সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি চট্টগ্রামের প্রকৃতির ওপর মানুষের অবিবেচক কর্মকা-ের চাপ বাড়তেই আছে। মানুষ বাণিজ্যিক স্বার্থে, কোনো অনৈতিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অনেকটা ‘জিম্মি করে’ পরিবেশের গলাটিপেই চলছে। এসব পরিবেশবিরোধী কর্মকা-ে ফলাফল যে ধীরে ধীরে কী মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে, তা কল্পনা করাও কঠিন। প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচার যতই বাড়তে থাকে, প্রকৃতি ততই হিং¯্র হতে থাকে। এক সময়ে সেই হিং¯্র প্রকৃতির রোষানলের শিকার হয় মানবজাতিই। হাতেগোনা কিছু পরিবেশ বিধ্বংসী, অবিবেচক মানুষের কর্মকা-ের কারণে প্রকৃতির প্রতিশোধের কবলে পড়ে পুরো অঞ্চলের সব মানুষ।
এসবের প্রতিকার কোথায় কিসে কিভাবেÑসে আলোচনার শেষ সীমানা পাওয়া দুস্কর। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোথায় কী গলদ। প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা, পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা কিংবা প্রকৃতির ওপর মানুষের যেসব অত্যাচার চলে সেসব থেকে আগ্রাসী মানুষজনকে বিরত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে যাদের কাঁধেÑসে প্রতিষ্ঠানটি হলো পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানটি কি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করছে? তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে এন্তার অভিযোগ।
পরিবেশ সচেতন মানুষের ভাষায়-এই অধিদপ্তরের ‘অদক্ষতা, অযোগ্যতায়’ কিংবা অধিদপ্তরের ভাষায় ‘জনবল সংকট-আইনি দুর্বলতাসহ’ নানা কারণে এই অঞ্চলের পরিবেশ যে দিন দিন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে তার স্বীকারোক্তি এ প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানেই মিলে। একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রচারিত এক প্রতিবেদনে পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র পরিসংখ্যান দিয়েছে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধুলোর পরিমাণ ১৫০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয়। কিন্তু ২০১৭ সালে নগরীর বাতাসে তার পরিমাণ মিলে ২৩২ মাইক্রোগ্রাম। পরের বছর ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৩ মাইক্রোগ্রামে এবং সর্বশেষ গত বছর বা ২০১৯ সালে মিলেছিল ৩৩০ মাইক্রোগ্রামে। বাসাতে প্রতি ঘনমিটারে প্রলম্বিত বস্তুকণা ২০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় মাত্রা। কিন্তু নগরে মিলেছে তার চারগুণ, অর্থাৎ ৮০০ মাইক্রোগ্রাম! পরিসংখ্যানই বলছে দিন দিন পরিস্থিতির কী ভয়াবহ অবনতি ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় কী ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব।

নগরীর যেসব এলাকায় পরিবেশ দূষণের কথা উল্লেখ করেছি, সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর কি ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তাও বলা উচিত। অভিযোগ আছে, প্রতিষ্ঠানটি নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে কখনো পরিবেশ সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়নি, কেবল পত্র-পত্রিকায় কোনো এলাকার পরিবেশ দূষণ নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে, অনেকটা বাধ্য হয়ে দায়ীদের ‘শুনানিতে’ ডাকে। শুনানি করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু টাকা জরিমানা করেন। একটি কারখানা পরিবেশ সম্মতভাবে চালাতে, ইটিপি চালু রেখে উৎপাদন করতে গেলে মাসে যে পরিমাণ খরচ যাওয়ার কথা, সে তুলনায় জরিমানার টাকার ‘খুবই নগণ্য। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, এভাবে চলতে চলতেই, এতদিনে প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশের এক প্রকারের ‘অপমৃত্যু’ তো ঘটেই গেছে, সেই মৃত পরিবেশ এখন মানুষজনকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে; যা স্বাভাবিক নয়Ñপরিবেশের মতোই ‘অপমৃত্যু।’

আবু মোশাররফ রাসেল গণমাধ্যমকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট