চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আলোচিত দুই মামলার রায়

২২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বহুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সোমবার দুটি আলোচিত মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। আদালত তিন দশক আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জনসভার আগে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদ- দিয়েছেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারির ওই ঘটনায় শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক আদালত ভবনের দিকে এগোলে নির্বিচারে গুলি ছোড়া শুরু হয়। অন্যদিকে, প্রায় দুই দশক আগে ঢাকার পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় হরকাতুল জিহাদের (হুজি) ১০ জঙ্গির মৃত্যুদ- হয়েছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে যে দিনটিতে বোমা হামলা চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছিল, ১৯ বছর পর সেই একই তারিখে রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে।

উল্লেখ্য, ৩২ বছর আগে লালদীঘি মাঠে সমাবেশের আয়োজন করে তৎকালীন ৮ দলীয় জোট। স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জোটের এ সমাবেশ সফল করতে মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিলে মিছিলে যোগ দিতে থাকে তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। দুপুর হতেই লালদীঘি মাঠ এবং আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। প্রধান স্লোগান ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের পদত্যাগ। বিপুল লোক সমাগমে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পুলিশ প্রশাসন, চলে গতিরোধের চেষ্টাও। শেষ পর্যন্ত সভায় যাওয়ার পথে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহর লক্ষ্য করে গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে মারা যান ২৪ নেতাকর্মী। আহত হন দুই শতাধিক। ঘটনাটি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলা’ হিসেবে পরিচিত। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে প্রয়াত আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ওই ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বহুল আলোচিত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের নির্দেশে সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রথম দফায় ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় মির্জা রকিবুল হুদাসহ আট পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় সাবেক মন্ত্রী, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ মোট ৫৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর যুক্তিতর্ক শেষ করে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলা’র রায় ঘোষিত হলো সোমবার। রায়ে আদালত দ-বিধির ৩০২ ধারায় পাঁচ আসামির মৃত্যুদ- প্রদান করেছেন। এ মামলায় অপর একটি ধারায় ৫ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি তৎকালীন ৮ দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার একটি বড় ধরনের টার্গেট ছিল বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পান।

অপরদিকে চার আসামির উপস্থিতিতে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা মামলার রায়ও ঘোষণা করেছেন আদালত। বিচারক ১০৪ পৃষ্ঠার রায়ে হামলার ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছিল। দীর্ঘ ১৯ বছর পর সেই বর্ষপূর্তির দিনেই রায় ঘোষণা করলেন আদালত। আদালত ১০ আসামিকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের দ-বিধির ৩০২/১২০বি/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদ- এবং প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আসামিরা হুজির সদস্য এবং তাদের ধারণা- সিপিবির লোকেরা কাফের, বিধর্মী, নাস্তিক, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয়। সে কারণে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করতে জঙ্গিরা ওই হামলা চালিয়েছিল। বোমা হামলার মাধ্যমেও পাঁচজন নিরীহ ও নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য হরকাতুল জিহাদের এই জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন আদালত। আদালতের পর্যব্ষেণে আরো বলা হয়েছে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং বিব্রত করার জন্য এ বোমা হামলা করা হয়েছে। আসামিরা দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নস্যাৎ করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। এ হামলার মাধ্যমে তারা নারকীয় হত্যাকা- ঘটিয়েছে।

দীর্ঘদিন পরে হলেও অপরাধীদের বিচার হওয়ার বিষয়টি স্বস্থির। এ রায় সন্ত্রাসীদের একটি কঠোর বার্তা দেবে। এতে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ মসৃণ হবে। তবে বিলম্বিত বিচারের কারণে মামলার অনেক আসামি ফেরারি হয়েছে। আগামিতে এ ধরনের সন্ত্রাসী কা- রোধ করতে তাদের ধরে এনে বিচারের রায় কার্যকর করতে হবে। একইসঙ্গে বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধেও নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। কারণ বিলম্বিত বিচার এবং আইনের ফাঁক গলে অনেক অপরাধীই ফেরারি হয়ে যায়। তাদের অধিকাংশই পুনরায় অপরাধ তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। আদালতের পর্যবেক্ষণগুলোও আমলে নিতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট