চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

গাউসুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (ক.)

শায়খ মুহাম্মদ মুহি উদ্দীন আযহারী

২২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম। ইসলামের অন্তর্নিহিত সত্য সুফিবাদ। এই সুফিবাদের ধারণা নবী (দ.) ও সাহাবাদের যুগে ভিন্নœ নামে সুপ্ত ছিল। পরবর্তীতে ইসলামী সমাজব্যবস্থার ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সুফিবাদ নামে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। সুফিবাদ চর্চার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বহু ত্বরিকা বিকাশ লাভ করে, যেমনঃ কাদেরীয়া, চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, নকশ্বন্দীয়, মুজাদ্দেদীয়া ইত্যাদি। হযরত শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (ক.) আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ পন্থা মাইজভা-ারী ত্বরিকার প্রবর্তন করেন। এই ত্বরিকা আচারধর্ম পালনের সাথে সাথে নৈতিক পরিশুদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়।

গাউছুল আজম হযরত শাহ ছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (ক.) আওলাদে রাসুল ছিলেন। তার পুর্বপুরুষ সৈয়দ হামিদ উদ্দীন গৌড়ি ১৫৭৫ সালে ইসলাম প্রচার মানসে চট্টগ্রামে আগমন করে পটিয়া থানার কাঞ্চননগরে বসতি স্থাপন করেন। তারই বংশধর মওলানা সৈয়দ মতিউল্লাহর পবিত্র ঔরসে ১৮২৬ সালে, হিজরী ১২৪৪, ১২৩৩ বাংলা ১লা মাঘ, রোজ বুধবার জোহরের সময় হযরত শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (ক.) জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম সৈয়দা খায়েরউন্নেছা বিবি। চার বছর বয়সে গ্রাম্য মক্তবে তার শিক্ষাজীবন আরম্ভ হয়। ১২৬০ হিজরীতে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা গমন করেন। ১২৬৮ হিজরীতে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এই সময় তিনি হাদিস, তাফসীর, ফেকাহ, মানতিক, বালাগাত, উছুল, আক্বায়েদ, ফালছাফা, ফরায়েজ ইত্যাদি শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শীতা অর্জন করেন। হিজরী ১২৬৯ সালে তিনি যশোর জেলায় কাজী (বিচারক) পদে যোগদান করেন। ১২৭০ হিজরীতে কাজী পদ ত্যাগ করে কলকাতার মুন্সি বু-আলী মাদ্রাসায় প্রধান মোদার্রেছের পদে যোগদান করেন। তার চারিত্রিক গুণাবলী ও জ্ঞানের ব্যাপকতায় মুগ্ধ কলকাতাবাসী তার ওয়াজ শুনার জন্য উন্মুখ ছিলো। তাঁর পীরে তরিকত ছিলেন পীরানে পীর দস্তগীর গাউছুল আজম মহি উদ্দীন আবদুল কাদের জীলানীর (রহঃ) বংশধর শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রহ.)। অপরদিকে পীরে তরিক্বতের বড়ভাই হযরত শাহ সৈয়দ দেলাওর আলী পাকবাজ (রহ.) এর কাছ থেকে কুতুবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন। তিনি বিল আছালত বা স্বভাবসিদ্ধ ওলী ছিলেন।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভা-ারী (ক.) তাঁর পীরে ত্বরিকতের নিদের্শে ১৮৫৭ সালে নিজ গ্রাম মাইজভা-ারে ফিরে আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার কামালিয়তের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঐশী-প্রেম পিপাসু সাধক ও দোয়া প্রত্যাশী ফরিয়াদিদের ভীড়ে এই সাধকের পবিত্র বাসগৃহ বিশ্ব-মানবতার কল্যাণধারক এক উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক দরবারে পরিণত হয়। লোকসমাজে পরিচিতি পায় ‘মাইজভা-ার দরবার শরীফ’ হিসেবে। ওফাতের পরও তার পবিত্র মাজার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মিলনকেন্দ্র। আজও ফরিয়াদিরা তার মাজারে এসে আপন হাজত-মাকসুদ পূরণের জন্য নজর-মানতসহ আল্লাহর দরবারে মিনতি করেন। এবং তাদের চাহিদাও পূর্ণ হচ্ছে নিয়মিতভাবে যা খোদার নেয়ামত এর এক তুঙ্গীয় বহিঃপ্রকাশ।

হযরত কেবলার (ক.) অসংখ্য কারামতের ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে ও লোকমুখে প্রচারিত। এই কারামতসমূহ ছিল আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ দান। তার পক্ষ থেকে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কারামত হচ্ছে- দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তিদান, অভাব-অনটন থেকে মুক্তিদানপূর্বক অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদান, নিঃসন্তানকে সন্তান দান, হাকিমের উপর আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ফরিয়াদির স্বপক্ষে মোকাদ্দমার রায় প্রদান, হযরতের আধ্যাত্মিক প্রভাবে অনভিজ্ঞ হেকিম এর হেকিম হিসেবে সুনাম অর্জন, তার শুভ দৃষ্টিতে মৃত্যুকষ্ট লাঘব এবং মৃত্যুকালে ঈমান রক্ষা, পথহারা, সহায়-সম্বলহীন হাজী সাহেবকে অলৌকিকভাবে গৃহে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দেয়া
বিশিষ্ট্য সুফিতাত্ত্বিক গবেষক ও বুযুর্গ হযরত মহি উদ্দীন ইবনুল আরাবী তার ‘ফছুছুল হেকম’ গ্রন্থের ‘ফচ্ছে শীচি’ অধ্যায়ে হযরত গাউছুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) এর আগমনের ও তার গাউছুল আজম হওয়ার শুভ সংবাদ ও ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। এছাড়া সমসাময়ীক ওলী-বুযুর্গগন তাকে ‘গাউছুল আজম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। সমসাময়ীক ও পরবর্তি সূফী ওলামায়ে কেরাম তার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন ও তার গাউছে আজমিয়তের আন্তরিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদীয়া সুন্নীয়া আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, ওলীকুল শিরোমনি হাফেজ মাওলানা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহ.) এর বর্ণনামতে “তিনি (গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ –ক.) এই জামানার আওলিয়াদের সম্রাট। হুকুমত তারই”।

তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আমীর মাওলানা সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) তার ‘দিওয়ানে আজিজ’ গ্রন্থে হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারীর (ক.) শানে যে প্রশংসাবাক্য লিখেছেন তা প্রণিধানযোগ্য- “হযরত শাহ আহমদ উল্লাহ কাদেরী পূর্বাঞ্চলে প্রকাশিত কুতুবুল আকতাব। তিনি মাইজভান্ডারী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত গাউছুল আজম (লকবধারী) বাদশাহ, যিনি উম্মতে আহমদীর জন্য হেদায়তের আলোকবর্তিকা। তার অনুগ্রহের ছায়াকে হুমা পাখির ছায়ার মতো জানো (যা দুর্ভাগাকে ভাগ্যবানে পরিণত করে), তিনি বিশ্ববাসীর জন্য লাল পরশমনি সদৃশ। পয়গম্বর (দ.) এর কাছে (বেলায়তে ওজমা বা শ্রেষ্ঠ বেলায়তের) দুটি তাজ ছিল, তার একটি হযরত শাহ আহমদ উল্লাহ এর মস্তকে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই কারণেই তিনি পূর্বাঞ্চলে অবস্থানরত গাউছুল আজম, তার রওজা জ্বীন, পরী, মানব (সকল) এর জন্য খোদায়ী অনুগ্রহের উৎস।

হযরত গাউছুল আজম মাইজভা-ারী (ক.) মাইজভা-ারী ত্বরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। মাইজভা-ারী ত্বরিকা কোরআন ও হাদিসভিত্তিক ইসলামের মৌলিক ভাবাদর্শের অনুসরণে প্রতিষ্ঠিত একটি ত্বরিকা। অন্যান্য ত্বরিকার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্টগুলো মাইজভা-ারী ত্বরিকায় একত্রিত হয়েছে। এই ত্বরিকা ছিলাছিলার দৃষ্টিকোণে কাদেরিয়া ত্বরিকার সাথে সম্পর্কিত। তাই এই ত্বরিকার বায়াত প্রদানকালে কাদেরিয়া ত্বরিকার উসুল অনুসরণ করা হয়। এই ত্বরিকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এ ত্বরিকা ইসলামী ভাবাদর্শকে পরিপূর্ণভাবে আত্তস্থ করার পাশাপাশি একই সাথে অসাম্প্রদায়িক, উদার ও সংস্কারমুক্ত, নৈতিক ধর্ম-প্রাধান্যসম্পন্ন, শ্রেণী-বৈষম্যহীন ও মানবদরদী।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভা-ারী (ক.) তার ওফাতের পূর্বে আপন নাতি হযরত শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভা-ারীকে (রহ.) স্বীয় গদী শরীফের উত্তরাধিকারী সাজ্জাদানশীন নির্ধারণ করে যান। হযরত কেবলা (ক.) এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমার ‘দেলাময়না’ বালেগ। দেলাময়নাই আমার গদীতে বসবে।” অছীয়ে গাউছুল আজম খ্যাত হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভা-ারী (রহ.) তার উপর অর্পিত এই গাউছিয়ত ক্ষমতায় মাইজভা-ার দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত হয়ে মাইজভা-ারী পরিম-লে আবির্ভূত হয়েছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী এক নতুন সত্ত্বা নিয়ে। সব্যসাচীর মতো যুগপৎভাবে রূহানি হেদায়ত আর মানবতার কল্যাণে তিনি সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন।
খেলাফত প্রদানের মাধ্যমে গাউছিয়ত জারি রাখার এই নিয়মের অনুসরণে হযরত শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভা-ারীও (রহ.) তার জীবিতাবস্থায় তদীয় তৃতীয় পুত্র হযরত শাহসুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভা-ারীকে (ম.) নিজ গদীর উত্তরাধিকারী ও দরবারে গাউছুল আজমের সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত করে যান।
তিনি শাহ সুফী সৈয়দ এমদাদুল হক (মঃ) কে সাজ্জাদানশীনের দায়িত্ব অর্পনের বিষয়টি জরূরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও তার লিখিত ‘মানব সভ্যতা’ নামক বইয়ের ভুমিকাংশে উল্লেখের মাধ্যমে প্রামান্যকরন করেন। তিনি জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “সৈয়দ এমদাদুল হক হানফী মজহাব সুন্নতে এজমা বিধি ফতোয়া মতে আমার মনোনীত সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত। এতদ্বসংগে আমি ঘোষণা করিতেছি যে, আমার অবর্তমানে হজরতের হুজুরা শরীফে আমার গদীর উত্তরাধিকারী বর্তমান নায়েব সাজ্জাদানশীন সৈয়দ এমদাদুল হককে আমি মনোনীত করে আমার স্থলাভিষিক্ত করিলাম। শিক্ষা দীক্ষা শজরা দান এবং ফতুহাত নিয়ন্ত্রন অধিকার সম্পন্ন, এই গাউছিয়ত জারী-সফলতাদানকারী সাব্যস্ত করিলাম।” খেলাফত প্রদানের মাধ্যমে সাজ্জাদানশীন মনোনয়নের বিষয়টি চলতি সময়ের প্রেক্ষপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাইজভা-ারী ত্বরিকার সঠিক আঙ্গিক ও ফয়েজ লাভের স্থান ও মূল মাইজভা-ারী পীর-মুর্শিদের আঙ্গিক সর্ম্পকে অবগত হওয়া জরুরি।

এ প্রসঙ্গে হযরত শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভা-ারী (রহ.) বলেন, “বিশেষতঃ পীর ছাড়া পীর, ধর্মীয় বাধঁন হারা ফকির, কোরান হাদিস, ছুফী মতবাদ জ্ঞানহীন ফিকিরবাজ লোকের কাজ কারবারের ফলে ফকীরীর নামে যে উশৃঙ্খলতা দেখা দিয়াছে এই গুলির প্রতিও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কামেল পীর, বুজুর্গানের নামে হুকুম, স্বপ্ন ইত্যাদি উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা কথা ফলাইয়া যাহারা এই ব্যবসা চালায় এবং সরল বিশ্বাসী লোককে ঠকায় তাহারা অনেকেই নিজের কোন ছিলছিলা দেখাইতে না পারায় নিজেকে মাইজভা-ারী বা আজমিরী বলিয়া পরিচয় দেয়। যেহেতু এই দেশে উক্ত দুই দরবারের নাম শান অতি প্রসিদ্ধ।”

গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (ক.) ৭৯ বছর বয়সে ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে, ১৩১৩ বঙ্গাব্দে ১০ মাঘ সোমবার দিবাগত রাতে ইহধাম ত্যাগ করেন। তার ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৮, ৯ ও ১০ মাঘ ৩ দিনব্যাপী ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ আশেক-ভক্তের ওরশ শরীফে অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলছে। ওরশ শরীফে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের ব্যাপকতা গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এর আধ্যাত্মিক মাহাত্ব ও তার ত্বরিকার সার্বজনীনতা ও ক্রমপ্রসারমানতারই এক অনুপম স্বাক্ষর।

শায়খ মুহাম্মদ মুহি উদ্দীন আযহারী প্রধান, পোর্টস মাউথ ইসলামিক সেন্টার, ইংল্যান্ড; খতিব, পোর্টস মাউথ জামে মসজিদ, ইংল্যান্ড।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট