চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কৃষকের সর্বনাশ, মধ্যস্বত্বভোগীদের পৌষ মাস

২০ মে, ২০১৯ | ১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বোরোর বাম্পার ফলনের পরও ফড়িয়াদের কারণে ধানের অর্ধেক দামও না পাওয়ার খবরটি খুবই উদ্বেগকর। মাঠভরা ধান ফলিয়েও যদি কৃষককে লোকসান গুনতে হয় তাহলে তার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? কৃষকরা জীবনের সব সঞ্চয়, এমনকি মহাজন থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কৃষিতে বিনিয়োগ করেন, ভালো ফলনের আশায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করেন লোকসানের জন্য নয়, ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার আশায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের কৃষকরা কখনোই উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাননি। লাভের গুড় খেয়ে ফেলে পিপঁড়া। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের দাপটের কাছে আমাদের কৃষককূল সবসময় অসহায় থেকেছেন। লোকসান গুনেছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বোরো ধানের বাম্পার ফলন তাদের কোনো লাভই হয়নি। উল্টো লোকসান গুনতে হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ বাজারব্যবস্থার কারণে। কৃষক ঠকানোর এমন চিত্র দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে শুভকর নয়।
দেশের সর্বত্র এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু ফলন বাড়লেও ফড়িয়াদের কারণে বাজারে ধানের দাম কম। উৎপাদিত ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই পাচ্ছে না কৃষক। বলা চলে মাঠের সোনালি ধান কৃষকের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে। অঞ্চলভেদে এবার ধান চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে অর্ধেক দামও মিলছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে কৃষকবান্ধব বাজার সৃষ্টিতে সরকারের ব্যর্থতা। আর এর কড়াগ-ায় সুযোগ নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী । ফসলের বাম্পার ফলন ঘটিয়ে কৃষক লোকসানে থাকলেও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে তারা। এতে হতাশ কৃষক। কৃষকরা ইতোমধ্যেই মানববন্ধন এবং ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের অকপটে স্বীকারোক্তি হচ্ছে, ‘সরকার কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতি বছর নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ করে। কিন্তু এতে প্রকৃত লাভবান হয় রাজনৈতিক কর্মী, মিলার ও ব্যবসায়ীরা। কৃষকের কোনো লাভ নেই।’ ভালো কথা। মন্ত্রীর কথায় বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবকিছু জানার পরও কৃষকস্বার্থ রক্ষায় তথা ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে কৃষকবান্ধব পদক্ষেপ নেই কোনো? সরকার প্রতি মণ ধানের দাম বেঁধে দিয়েছে ১ হাজার ৪০ টাকা। কিন্তু আড়তদারেরা তা মানছেন না। কৃষকরা ভেজা ধান প্রতি মণ ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়, শুকনো ধান ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এই ধান কাটতে শ্রমিকপ্রতি দিনে পারিশ্রমিক দিতে হচ্ছে এক হাজার টাকা করে। এভাবে খরচের বিপরীতে ‘পানির দরে’ ধান বিক্রি করে চরমভাবে ঠকছেন কৃষকরা। কিন্তু এ ব্যপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্লিপ্ত থাকা খুবই দুঃখজনক। দাম বেঁধে দিয়ে তা মানতে সংশ্লিষ্টদের বাধ্য করাও সরকারের দায়িত্ব। এতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।
হয়তো মাসদুয়েক পরে বিক্রি করা হলে কৃষক উৎপাদিত ধানের ভালো দাম পেতেন। কিন্তু পাওনাদারের তাগাদা, ঋণের ওপর সুদের বোঝা, সংসারের দৈনন্দিন খরচ এবং নতুন মৌসুমের ফলনের প্রস্তুতিসহ নানা কারণে এখনই বিক্রি না করে ধান রেখে দেয়ার কোনো পথ খোলা নেই চাষির সামনে। আমরা মনে করি, কৃষকদের প্রকৃত জাতীয় বীর হিসেবে মানলে তাদের ন্যায্য সম্মান ও স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকা দরকার। কৃষক ন্যায্য দাম প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বারবার প্রতারিত হলে চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এমনটি হলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। উৎপাদক কৃষকের সর্বনাশ করে ফড়িয়া-ফটকাবাজ-মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেট ভারি করার সুযোগ চলমান থাকলে অমিত সম্ভাবনার কৃষি মুখ থুবড়ে পড়বে। ভেঙে পড়বে জাতীয় অর্থনীতিও। তাই সময় থাকতেই কৃষককূলের ন্যায্য অধিকারের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট