চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা

অধ্যাপক ড. নারায়ন বৈদ্য

২১ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে ধীর গতিতে। বাংলাদেশের সব খাতে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তন ধনাত্বক। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা এ ধনাত্বক পরিবর্তনের সুযোগ ভোগ করছে। তাদের মেধা, কর্মশক্তি এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে বেশি। এ দেশের অনেক কিছুই আন্তর্জাতিক মানের। বিশে^র সকল দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় গিয়ে জয়ী হয়েছে এদেশের পোশাক শিল্প।

পাশ্চাত্যের দেশে কোন পণ্য রপ্তানি করা সহজ ব্যাপার নয়। পণ্যের গুণগতমান উন্নত না হলে এসব দেশে পণ্য রপ্তানি করা অসম্ভব ব্যাপার। অথচ পোশাক শিল্পের প্রসারতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য রপ্তানি বৃদ্ধির পেছনে সরকারের প্রণোদনাও সহায়তা করছে। সোনালী আঁশের চাহিদা হ্রাস পাওয়ার পর যে সব পণ্য রপ্তানিতে অবদান রেখেছে তার মধ্যে পোশাক শিল্পের পণ্য, চা, চামড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সমগ্র বিশ^ব্যাপী বাংলাদেশের উৎপাদিত চা-এর স্থান দ্বিতীয়। ভারতের আসাম রাজ্যে উৎপাদিত চা বিশে^র প্রথম স্থানে রয়েছে। আর চামড়া তো উৎপাদনের দিক থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। যদিও প্রক্রিয়াজাতকরণের কারণে চামড়া শিল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কিছুতেই বিশে^র অন্যান্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পিছিয়ে রয়েছে এ দেশ। এত প্রচেষ্টার পরও এবং এত সরকারি অর্থ ব্যয় করার পরও কেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পিছিয়ে রয়েছে তা শুধুমাত্র বিগত বছরের (২০১৯) অবস্থা পর্যালোচনা করলে তা ষ্পষ্ট হয়ে যাবে। ২০১৯ সাল বছর জুড়ে ছিল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা।
বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে (সরকারি-বেসরকারি) পরিচালনার জন্য রয়েছে বিশ^বিদ্যালয় মজুরী কমিশন (ইউজিসি)। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে যে, ২০১৯ সালে একাধিক পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যাপারে তদন্ত করতে হয়েছে ইউজিসিকে। যদিও ইউজিসি সরাসরি কোন বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারে না, কিন্তু সরকারকে সুপারিশ করতে পারে। ২০১৯ সালে ইউজিসি-এর একাধিক সুপারিশের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থাও নিয়েছে। এক্ষেত্রে ইউজিসি-এর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকায় অনেক কিছু ইউজিসিকে অবজ্ঞা করতে হয়েছে।

উচ্চ শিক্ষায় অস্থিরতা ছিল ২০১৯ সাল জুড়েই। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দীর্ঘ সময়ের জন্য অচল ছিল একাধিক পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়। এমনকি দুইজন উপাচার্য শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন। ২০১৯ সালের মার্চের শেষের দিকে বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অস্থিরতা। ঐ বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে প্রথমে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলেও পরে তাদের সাথে যুক্ত হয় শিক্ষকেরা। সেই আন্দোলনের মুখেই উপাচার্য মহোদয় পদ ছাড়তে বাধ্য হন। বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ের পর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তপ্ত হয়ে উঠে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। উক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী নিজের ফেসবুক ওয়ালে ‘বিশ^বিদ্যালয়ের কাজ কী?’ লেখায় তাকে শুধু বহিস্কারই করেনি মাননীয় উপাচার্য, ছাত্রীর বাবা ও পরিবারকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলায়ও মদদ দেন মাননীয় উপাচার্য। এর ফলে শেষ পর্যন্ত উপাচার্য মহোদয়কে পদত্যাগ করতে হয়।

২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, দিনাজপুরে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয় ছিল অশান্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় প্রায় ২০১৯ সাল জুড়েই ছিল অস্থির। বিশ^বিদ্যালয় উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং গাছ কাটা নিয়ে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখার দুইজনের নাম। নভেম্বর মাসে রূপ নেয় ভিসির পদত্যাগ দাবির আন্দোলনে। এমন কি বিশ^বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টা ছিল, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া গুচ্ছ পদ্ধতি সম্পূর্ণ করা। ২০১৯ সালে অন্যান্য পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলো সফল না হলেও কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও কৃষি অনুষদ সংবলিত সাত পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির দাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। এ দেশের আম-জনতার দাবী সত্বেও কিছু পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের অসহযোগিতার কারণে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি প্রক্রিয়া এখনও সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে যে, ২০২০ সাল থেকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করা হবে।

২০১৯ সালের আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন শিক্ষার্থীকে হত্যা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশ^বিদ্যালয়ের কিছু রাজনৈতিক কর্মী তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। ঐ ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে বুয়েট। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় দ্রুতই ধরা পড়ে অপরাধীরা। তবে দীর্ঘদিন অচল ছিল বুয়েট। এমন কি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপেই শেষ পর্যন্ত বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০১৯ সালে দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। নানা উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর সংঘর্ষের পর ১১ মার্চ ঐ নির্বাচন হয়। কিন্তু নির্বাচন শেষ হলেও ডাকসু পরিস্থিতি বছর জুড়েই ছিল আগ্রহের কেন্দ্রে। ডাকসু-এর নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন নেতা। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে উক্ত ভিপি যেখানে গেছে বেশির ভাগ জায়গায় মারধরের শিকার হয়েছে।

২০১৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্যতম অর্জন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বিশ^স্বীকৃতি আদায়। ইউনেসকো ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর মুজিববর্ষকে বিশ^স্বীকৃতি দেয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন হবে বিশ^ব্যাপী ১৯৫টি দেশে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের তত্ত্বাবধানেই মুজিব বর্ষের বিশ^স্বীকৃতি আদায়ে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ২০১৯ সাল অতিবাহিত হয়েছে ভাল-মন্দ মিশিয়ে। তবে ২০২০ সালে এ দেশের সকল অভিভাবক আশা করে যে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলো যে কোন অবস্থায় গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করবে ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে।

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাষ্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট