চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

৭-২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলি ও বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার প্রসঙ্গ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর )

নাওজিশ মাহমুদ

১৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

নির্বাচনের পর পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্টকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পাঞ্জাব ও সিন্ধের নির্বাচিত নেতা জুলফিকার আলি ভূট্টোকে। ভূট্টোর চাপে পড়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপর আস্থা হারিয়েছেন।

১৭ মার্চ আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসলেন। এই আলোচনায় উভয় পক্ষ অনড় রইলেন। মিমাংসা ছাড়াই সেদিনকার আলোচনা শেষ হয়। ১৮ মার্চেও একই অবস্থা।
তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন প্রস্তাব দেয়া হয়। সামরিক আইন তুলে নিয়ে প্রদেশের শাসনভার নির্বাচনে জয়ী দলসমূহের হাতে তুলে দিতে হবে। ইয়াহিয়া খানকে প্রেসডেন্ট রেখে দুই প্রদেশের সদস্যরা ঢাকায় এবং ইসলামাবাদে বসে খসড়া প্রস্তাব পেশ করবেন। তারপর উভয় পক্ষ আলোচানায় বসবেন দ্বিমত বিষয়ে নিষ্পত্তি করার জন্য। ইয়াহিয়া খান এই প্রস্তাব এই শর্তে মেনে নিলেন যদি ভুট্টো আপত্তি না করেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট থাকবেন কোন আইন বলে যদি সামরিক আইন না থাকে। কারণ জাতীয় পরিষদ একসাথে না বসা পর্যন্ত কোন আইন তেরী হবে না। ভুট্টোর সম্মতির প্রয়োজন হবে। কিন্তু ভুট্টো ঢাকায় আসতে অস্বীকার করছিলেন। ভট্টোকে ঢাকায় আনার জন্য বার বার চেষ্টা করা হচ্ছিল।

২১ মার্চ ভুট্টো ঢাকায় আসলেন তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে। কিন্তু ভুট্টো এই প্রস্তাবে রাজী হলো না। কারণ সামরিক আইন প্রত্যাহার হলে তার ক্ষমতার মূল উৎস দুর্বল হয়ে যাবে। তিনি সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতায় পরিণত হবেন। সেই সাথে জাতীয পরিষদে নির্বাচিত ছোট ছোট দলের পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা, ওয়ালী খান, সরদার হায়াত খান, মুফতি মাহমুদ, গাউস বক্স বেজঞ্জো ঢাকায় আসেন। যাতে একটি সমাধান খুঁজে বের করা যায়।
এদিকে সমস্ত জনতা, তরুণরা এবং ছাত্ররা স্বাধীন বাংলাদশের প্রতিষ্ঠার মিছিল সভা, জয়বাংলা শ্লোগান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে স্বাধীনতাকে বরণ করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে। ঢাকাসহ সারা দেশ শ্লোগানে মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। একটায় দাবি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু নিজেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন তাঁর বাসভবনে।

২২ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সমঝোতা না হওয়ায় ২৫ মার্চ অনষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবারও স্থগিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও জাতীয় পরিষদ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন নি।
২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ নতুন প্রস্তাব দেয় দুই প্রদেশের জন্য দুই শাসনতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আলাদা প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তান হবে একটি কনফেডারেশন। ভূট্টো এই প্রস্তাবে সানন্দে সায় দেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বেঁকে বসলেন। তাজউদ্দিন ঘোষণা করলেন আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তাব পেশ করা হয়ে গিয়েছে আর ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
২৫মার্চ সন্ধায় ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করলেন, ঢাকায় বাঙালিদের উপর আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে খবর পেয়ে যান। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাাহনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণ চালায়। তাঁর পূর্বে ক্যান্টনমেন্টে ও ইপিআর সদর দপ্তরে বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করা হয়। তাঁদের সর্বপ্রথম টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা এবং বাধা পেলে হত্যা করা। দ্বিতীয় টার্গেট ছিল বেতার ও টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। তৃতীয় টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেয়া। চতুর্থ টার্গেট ছিল রাজারবাগের পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া। পঞ্চম টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধু পরবর্তী নেতাদের হত্যা করা, বিশেষ করে তাজ উদ্দিনকে হত্যা করা।
আলোচনার অচলাবস্থার মধ্যে কোন সিদ্ধান্ত না আসায় নেতৃবৃন্দ একটু দোলাচলে ছিলেন, দ্বিধা ও উৎকণ্ঠায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কি সিদ্ধান্ত নেন। ইয়াহিয়া খান হঠাৎ ঢাকা ত্যাগ করায় এটা পরিষ্কার হয়ে যায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকক্সক্ষাকে মোকাবিলা করবে। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে বিএলএফ হাই কমান্ডকে ডেকে আওয়ামী লীগের গণপরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে কলকাতায় কার সাথে ও কোথায় যোগযোগ করতে হবে তার ব্যবস্থা করে যান। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বলে যান। এটা বলেও যান বিএলএফএর সদস্যরা যুদ্ধ করবে আর তাজউদ্দিন সরকার চালাবে।
পাকিস্তান সামরিক কর্তপক্ষ চট্টগ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্টর উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বাঙালি সামরিক কমান্ডার মাহমুদুর রহমার মজুমদারকে কৌশলে গ্রেফতার করে। পিলখানায় ইপআির সদরদপ্তরে হামলা চালিয়ে অনেক বাঙালি সৈনিকেকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার এবং ঢাকার প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য নিরস্ত্র বাঙালি উপর ঝঁপিয়ে পড়েন। যেখানে সামান্য বাধা পায়, সেখানে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি আক্রমণ করে হাজার হাজার ছাত্রকে হত্যা করে, শিক্ষকদের উপর হামলা করে হত্যা করে। রাজারবাগের পুলিশ লাইন আক্রমণ করেন। সেখানে সামান্য প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়। সেখানেও নিবর্বিচারে গণহত্যা চালায়। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এই সময় কার্ফিউ দিয়ে জনতাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। ঢাকা শহর তখন ছিল প্রায় অচল অবস্থা। সমস্ত রাস্তা ঘাটে ছিল জনতার দেয়া ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড অতিক্রম করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বঙ্গবন্ধু এবং নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করতে যে সময় লাগে এই সময়ে স্বাধীনতার জন্য এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে একটি নির্দেশনার সুযোগ পেয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সংগৃহীত গোপন ট্রান্সমিটারে ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হকের (পরবর্তীকালে শহীদ) কাছে রক্ষিত ছিল, সেখানে টেলিফোনের মাধ্যমে স্বাধীনতার বার্তা পাঠানোর পর মেসিনটি ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন বলে বঙ্গবন্ধুর ব্যািক্তগত সহকারী হাজী গোলাম মুর্শেদ উল্লেখ করেন। মগবাজার ওয়ারল্যাস কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার বার্তা চট্টগ্রামের সলিমপুরের স্টেশনসহ সারাদেশের অন্যান্য ওয়ারল্যাস স্টেশন কেন্দ্রে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে যেহেতু বঙ্গবন্ধু টেলিফোন নজরদারীতে ছিল, তাই পরোক্ষভাবে চট্টগ্রামে এম আর সিদ্দিকীর কাছে সন্ধা ৭টার দিকে প্রতিবেশির বাসার টেলিফোনের মাধ্যমে স্বাধীনতা বার্তা পাঠিয়ে দেন। যার ভিত্তিতে চট্টগ্রামে প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্বেই স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে, তা নিশ্চিত করে যান। তবে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লে. কর্নেল জেড এ, খান ও মেজর বিল্লাল ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ৩২ ধানমন্ডির বাসা থেকে। জেনারেল মিঠ্ঠাা খানের ব্যক্তিগত অনুরোধ ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের মাধ্যমে এবং বাঙালিদের উপর কাপুরুষোচিত আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা মনে করেছিল বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে। বঙ্গব›ন্ধু গ্রেফতারের পর বাঙালি প্রথমে দিশেহারা হলেও তার নির্দেশিত পথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাঙালির এই প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকেই বাঙালি নতুন রাষ্ট্র গড়ার লড়াই শুরু করে। (সমাপ্ত)

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট