চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মানবিকবিশ^ গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখুক ধর্ম

খন রঞ্জন রায়

১৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের সংসদ ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একটি আইন পাশ করে। এই আইনে মূলত ধর্মীয় হানাহানি রোধ করে রাজ্যে রাজ্যে, দেশে-দেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়। থমাস জেফারসন কর্র্তৃক খসড়া প্রস্তুতের পর জেমস মেডিসন মানবজাতির শ্রেষ্ঠ উপহার এই আইনটি মার্কিন সংসদে উপস্থাপন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তাঁদের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর আলোকবর্তিকা হিসাবে উদ্ভাসিত হয়েছিল এই আইন। বিশ্বের উদার ও মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত অহিংস আচরণ, অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল মনোভাব পোষণের আকাক্সক্ষার এই দিনটিকে স্মরণীয় রাখা হয়। ঐ দিনটি ছিল জানুয়ারি মাসের তৃতীয় রবিবার। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের বাহাই সম্প্রদায় ‘ধর্মের অভিন্নতা দাবী করে সর্বধর্মীয় ঐক্য স্থাপনের লক্ষ্যে দিনটিকে ‘বিশ্ব ধর্ম দিবস’ হিসাবে পালনের যুক্তিসম্মত আহবান করে। কল্যাণ ও মঙ্গলের অদ্বিতীয় ক্ষেত্র হিসাবে তুলে ধরে ঐ তারিখ ও বছরে প্রথম ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে দিবস পালন শুরু হয়।

সমগ্র পৃথিবীতে ৪ হাজারের অধিক ধর্মীয় মতবাদের বিশ্বাসীদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর বাইরেও আরো আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক, এলাকাভিত্তিক আরো অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। তবে সব ধর্মীয় মতবাদের সম্মিলিত একক আদর্শই হচ্ছে ঈশ্বরাজ্ঞা ও ধর্মানুষ্ঠানের নির্ভর আচার, আচরণ, প্রথাসমূহের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্য। পূর্বপুরুষ হতে প্রাপ্ত ঐতিহ্য, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, রীতিনীতি ও প্রথাকে যথাযথ মেনে, অনুসরণ করা। সুবিন্যস্ত ও লিপিবদ্ধ প্রত্যাদেশসমূহ আদৃষ্ট হওয়া ও প্রচার করা। ধর্মীয় চর্চার আচার, অনুষ্ঠানে নৈতিক বক্তৃতা, ধ্যান প্রার্থনা, গান শিল্পকলা, নাচ, জনগণের সেবা, ধর্মীয় গ্রন্থ, ধর্মীয় প্রতীক ও পবিত্র স্থানসমূহের প্রতি আনুগত্য থেকে জীবনের অর্থ দান করা। পূর্ণশক্তির পরিতৃপ্তি অর্জন করতে বিশ্ব বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানাতে আহবান করা হয়েছে। ব্যক্তি সামর্থ্যকে উজ্জ্বীবিত করে পারস্পরিক মনোভাবের আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে একীভূত হয়ে পৃথিবীর প্রতি ত্রৈমাত্রিক ভালবাসায় সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব বলে তাদের নিরন্তর বিশ্বাস।

ধর্মীয় বিশ্বাস নিরন্তর নিরবধি। মানুষ যখন লেখার পদ্ধতি আবিস্কার করে সেই ৫ হাজার ২ শত বছর আগে থেকেই ধর্মকে আলাদা মর্যাদার আসনে আসীন করে। এরপর থেকে পৃথিবী যত আধুনিক হতে থাকে ‘ধর্ম’ শব্দটি তত প্রাসঙ্গিক হিসাবে প্রকাশ ঘটে।
মধ্যপ্রাচ্যে আবির্ভাব হওয়া এক কোটি অনুসারীর ‘ইহুদি’ ধর্ম প্রভাব পতিপত্তিতে বেশ প্রাধান্য বিস্তার করে সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলছে। সাধক পুরুষ গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক আড়াই হাজার বছর আগে প্রবর্তিত ধর্মগ্রন্থ ‘ত্রিপিট’কের অনুসারি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আছে পৃথিবীতে প্রায় ৫০ কোটি। যিশুখ্রিস্টের জীবন ও শিক্ষাকে কেন্দ্র করে ২ হাজার বছর যাবৎ ‘বাইবেল’ ধর্মগ্রস্থ বিকশিত হওয়া ২৪০ কোটি খ্রিস্ট অনুসারী নিয়ে পৃথিবীজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করছে এই ধর্ম।

ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব, জাকাত এই পাঁচ মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে ১৮০ কোটি মুসলমান নিয়ে দেড় হাজার বছর যাবৎ দ্রুত প্রসারমান ধর্ম ‘ইসলাম’। পৃথিবীর সবচেয়ে জনসংখ্যার দেশ চীনে ‘হান’ নামের লোকধর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। যেটিকে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ধর্মীয় অনুসারী বলা হয়। কোন ধর্মই পূর্ণাঙ্গ মিথ্যা নয়, প্রচলিত কোন ধর্মই পরম সত্য নয়, এই বিশ্বাস নিয়ে একেশ্বরবাদী চেতনায় তিন কোটি মানুষের ধর্ম ‘শিখ’। নির্দিষ্ট কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, যুগে-যুগে, কালে-কালে ২৪ জন তীর্থঙ্কর পালা করে সারা পৃথিবীর মানবজাতিকে সৎ, কর্মনিষ্ঠ জীবনযাপনে দিকনির্দেশনা দিতে আর্বিভূত হয়ে আচার রীতিতে ভারতীয় সংস্কৃতির সামাঞ্জস্যপূর্ণ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপীয় দেশসমূহে বসবাসকারী ‘জৈন’। এই ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৪০ লাখ।

ঈশ্বরে পরকালে বিশ্বাসহীন, বাঁধাধরা নিয়মকানুনহীন, কোন ধর্মগ্রন্থহীন, সুনির্দিষ্ট কোন প্রচারক বা ধর্মগুরুহীন এক ধর্মীয় অনুসারি গোষ্ঠীর ‘শিন্তো’। জাপানের অনানুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি নিয়ে মানুষের কল্যাণকামী এই ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৪০ লাখ।
আদিকাল থেকে পরম্পরা চলে আসা বিশ্বের প্রাচীনতম জীবিত আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক বিশ্বাস হচ্ছে সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম। অহিংসা, ধৈর্যশীলতা, সততা, সমবেদনা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মানবিকতা উৎকর্ষে পারমার্থিক শান্তি ও মোক্ষ লাভের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই ধর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যা ১৩০ কোটির মতো। সারা পৃথিবীব্যাপী এই ধর্মাদর্শের বিশাল ব্যাপ্তি।
ধর্মের উৎপত্তিগত ক্রমবিন্যাসে যত মত ও পথ পাওয়া যায় সবকয়টির মূলে রয়েছে মানবতাবাদ, মানুষকে মুক্তি-কল্যাণ। ধর্মের মূলতত্ত্ব অধ্যয়নে মানবজাতির সামাজিক কাঠামো, সংস্কৃতির শিল্পবোধকে প্রভাবিত করার স্বরূপ উন্মোচন হয়। সভ্যতার বিকাশে জটিল সমাজকে সকল মতবাদ সমন্বয়ের মাধ্যমে বির্তক পরিহার করে মানুষের ন্যায্যতা নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ‘ধর্ম দিবস’ পালনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। শক্রতার মনোভাব পরিহার করে আত্মীক-ঐশ্বরিক সর্ম্পক জাগ্রত হোক মানবজাতিগোষ্ঠীতে আজকের দিনে এই প্রত্যাশা।

খনরঞ্জন রায় টেকসই উন্নয়নকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট