চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন

মীর নাজমিন

১৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। শিক্ষাই জাতির ভিত্। একটি জাতিকে সভ্য হতে হলে, শক্তিশালী হতে হলে, বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে, উন্নতির শিখড়ে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন যথাযথ শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতিই সভ্য হতে পারে না। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতিই উন্নতি লাভ করতে পারে না। কেবল শিক্ষাই পারে, একটি জাতিকে সভ্যজাতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে। কেবল শিক্ষাই পারে জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে খুব সহজেই তা অনুমান করতে পারি আমরা। তাইতো ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে দেশের বার্ষিক বাজেটের সিংহভাগই বরাদ্ধ রাখা হয় শিক্ষা ও গবেষণা খাতে। আর জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। তাই শিক্ষকদের জাতি গড়ার কারিগর বলা হয়। দেশের আনাচেকানাচে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে, দেশকে স্বনির্ভর ও উন্নত দেশে রূপান্তর করার লক্ষ্যে যেসব ব্যক্তি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, নিঃসন্দেহে তারাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারাই জাতির গর্ব। দেশে সর্বোচ্চ সম্মান এবং সম্মানী পাওয়ার দাবিদার তো তাদেরই হওয়া উচিৎ।

আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ৪টি ভাগে বিভক্ত। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। এই ৪টি স্তরের মধ্যে প্রাথমিক স্তরই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একজন মানবশিশুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে তার শৈশবকাল, যখন সে প্রথম ঝরঝরে মাতৃভাষায় কথা বলতে শিখে, যখন সে তার চেনা পরিচিত পরিবারের গ-ি ছেড়ে প্রথম বাইরে পা দিতে শিখে, জীবনে প্রথমবার যখন সে পরিবার ছেড়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে যায়। যখন একটা শিশুকে ৫ বা ৬ বছর বয়সে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়, তখন সে ভালো করে শুদ্ধ বাংলায় কথাটুকুও বলতে শিখে না। শিশুর পরিবারের পরে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই তাদের ভাষা শিখতে, কথা শিখতে সাহায্য করি, যা মাধ্যমিক বা শিক্ষার অন্য স্তরগুলোতে প্রয়োজন পড়ে না। শুধু কি কথা বলা! পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরুকরে নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রথম তাদের সামনে নিয়ে আসি আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই। মুখে বলেই শুধু ক্ষান্ত নই আমরা। অনেক সময় এমনও হয় যে, শিশুদেরকে আমরা নিজের হাতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও করে দিতে হয়। অ আ ক খ ১ ২ বা অ ই ঈ উ এর মতো শিশুর জীবনের প্রথম পাঠের হাতেখড়ি হয় প্রাথমিক স্তরেই। যা পরবর্তীতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ভীত গড়ে দেয়। অর্থাৎ মাধ্যমিক বা অন্যান্য স্তরে গিয়ে যে গাছটা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়, তার প্রথম বীজটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাত ধরেই পুঁতিত হয়ে থাকে। তাই নিঃসন্দেহে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরই অন্য স্তরগুলোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশি মূল্যবান। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা দেয়া শিক্ষকরাই দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। কারণ একজন নবীন শিক্ষার্থীকে বর্ণমালা ও বাক্য গঠন এবং শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ আত্মস্থ করার জন্য যেটুকু পরিশ্রম একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে করতে হয়, অন্য শিক্ষকদের তা কখনোই করতে হয় না। অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কোনো পিয়ন বা দপ্তরী নেই। তাই বিদ্যালয়ে পৌঁছে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রথমেই দপ্তরী হয়ে বিদ্যালয়ের তালা খোলা, বিদ্যালয় আঙিনা, বিদ্যালয়ের ক্লাসরূম, অফিস পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হয়। উপস্থিতির খাতায় সাইন করার পর তৈরি করতে হয় পাঠ পরিকল্পনা। ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান সারতে হয়। ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখতে হয়। তাদের সবল, দুর্বল চিহ্নিত করতে হয়। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর খোঁজখবর নিতে হয়। কারণ শিক্ষার্থী আসেনি, তার জন্য শিক্ষক দায়ী। শিক্ষার্থী রিডিং পড়তে পারে না, তার জন্য শিক্ষক দায়ী। শিক্ষার্থী ফেল করলো, তার জন্য শিক্ষক দায়ী। শিক্ষার্থী ঝরে পড়লো, তার জন্যও শিক্ষকই দায়ী। দৈনন্দিন এসব কাজ করার পাশাপাশি তাই মাসে একবার নিয়মিত অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর হোম ভিজিটও করতে হয় প্রতিটি শিক্ষককে। এদিকে আবার প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েই রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা। ৭জন শিক্ষকের স্থলে ৩/৪ জন এমনকি ২ জন শিক্ষক দিয়েও চলছে কোনো বিদ্যালয়।

ফলে ঐ দুজন বা তিনজন শিক্ষককে করতে হয় ৭ জন শিক্ষকের কাজ। তারপর প্রাথমিক অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ২/১টা করে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়। বছরে প্রতি তিনমাস পর পর শিশুদের কৃমিনাশক ঔষধ, ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে হয়। তিনবার সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা নিতে হয়, খাতা দেখতে হয়, ফলাফল তৈরি করতে হয়। প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিতে হয়, খাতা দেখতে হয়। বছরের জাতীয় দিবসগুলো পালনের পাশাপাশি মীনা দিবস, হাতধোয়া দিবস, বিজয়ফুল তৈরি প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের। এসব বাদেও বছরের বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন জরীপ যেমন শিশু জরীপ, আদমশুমারি থেকে শুরু করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ পর্যন্ত করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ধর্ণা দিতে হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও করতে হয়। কিন্তু নেই কাক্সিক্ষত সম্মান বা সম্মানী। দেশকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে যে সকল মহৎপ্রাণ মানুষগুলো সকাল থেকে সন্ধ্যাবধি গাধার মতো খাটাখাটনি করে যাচ্ছেন, ১৫তম গ্রেডে মাত্র ১৬ হাজার টাকা বেতন দিয়ে কেমন চলছে তাদের সংসার-জীবন কেউ কি তার খোঁজ রাখে? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর আকাশছোঁয়া দামের এই বাজারে এই ১৬ হাজার টাকা দিয়ে কতটুকু কি হচ্ছে একজন প্রাথমিক শিক্ষকের সংসারে, কেউ কি রাখছেন সেই খোঁজ। মাসশেষে মাত্র দুইশ টাকা টিফিন ভাতা। শিক্ষকদের মাসিক চিকিৎসা বাবদ বরাদ্ধ মাত্র দেড় হাজার টাকা। অথচ সামান্য একটা ভাইরাস জ্বর নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ২/১ টা টেস্টের দামও এরচেয়ে বেশি যায়। তাহলে এবার ঔষধ আর পথ্য কোত্থেকে আসে?

নিঃসন্দেহে শিক্ষকতা একটা মহান এবং সম্মানীয় পেশা। কিন্তু শুধুমাত্র ‘মহৎ’ আর ‘সম্মান’ দিয়ে তো একজনের জীবন চলে না। একজন মানুষ হিসেবে যদি তার মৌলিক ৫টা প্রয়োজন-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন মিটাতেও হিমশিম খেতে হয়, সেখানে মহৎ চিন্তা কোত্থেকে আসবে? অথচ এই ৫টি হচ্ছে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তাই নিজেদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে, নিজেদের অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখার স্বার্থে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। এটা কোনো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বলে মনে হয় না। অথচ জাতীয় শহীদ মিনারের মতো পবিত্র একটা জায়গায় সম্মানিত শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশি বাধা দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র বাধাই নয়, পুলিশ কর্তৃক জাতি গড়ার সম্মানিত কারিগরদেরকে লাঠিপেটা করতেও এতটুকু হাত কাঁপেনি। শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে ব্রত করাই কি আমাদের অপরাধ?
শিক্ষা ছাড়া কোনো অর্জনই সম্ভব নয়। শিক্ষা ছাড়া কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। তাই মাননীয় প্রধানমত্রীর সমীপে আবেদন, প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে ১০ম ও ১১দশ তম গ্রেড প্রদানের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মান বৃদ্ধি করা হোক। যাতে শিক্ষকরা অন্তত মাথা তুলে গর্বের সাথে বলতে পারেন, আমি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষকরা যেনো ন্যূনতম সম্মান নিয়ে সমাজে বাঁচতে পারেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সন্তোষজনক, সম্মানজনক এবং স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। আমরা আশা করতে চাই, শিক্ষাবান্ধব ও মানবতার জননী খ্যাত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবেন।

মীর নাজমিন শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট