চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জিপিএ-৫ এবং অভিভাবকদের মানসিকতা

রেজা মুজাম্মেল

১৮ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:২২ পূর্বাহ্ণ

সন্তানের ভাল ফলাফল- যে কোনো মা-বাবার জন্য পরম আনন্দের। সন্তান সর্বোচ্চ ফলটা অর্জন করুক, সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে সেরা হোক, আগামীর জন্য একজন ভাল শিক্ষার্থী হিসাবে সাফল্যের পালক অর্জিত হোক, এটি সকল অভিভাবকের আন্তরিক প্রত্যাশা। সম্ভবত এর ব্যত্যয় ঘটে না। সন্তানের উজ্জ্বল ফলাফলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খুশি হন পিতামাতাই।

গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেলেই বাবা-মা অনেক বেশি খুশিতে উদ্বেলিত হন। সকল মা বাবার অভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা- সন্তানকে যেকোনো মতেই জিপিএ-৫ পেতে হবে। জিপিএ-৫ অর্জন করতে না পারলে মনে হয় সন্তানের শিক্ষা জীবনের অনেক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই পরীক্ষার আগে এবং পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সন্তানকে দিন-রাত বিরতিহীনভাবে লেখাপড়ার মধ্যে ডুবিয়ে রাখেন। এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীরা বেমালুম ভুলে যায় বিনোদন কিংবা খেলাধুলার কথা। অধিকাংশ পরীক্ষার্থীকে খাওয়া আর ঘুম ছাড়া তৃতীয় কোনো কাজে লিপ্ত হতে দেওয়া হয় না। অনেকটা একঘেয়েমি জীবনেই সময় কাটাতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু এটা কি ঠিক? বয়স, শিক্ষার্থীর মানসিক চিন্তা-চেতনা, পড়ার চাপ ধারণ করার সক্ষমতা এবং সর্বোপরি এ সময়ের চাপ সহ্য করতে মানসিকভাবে সে কতটুকু প্রস্তুত, এতসব বিষয় কি অভিভাবকরা চিন্তা করে দেখেন।
দুই. ২০১৯ সালের পিএসসি এবং জেএসসি ফলাফল প্রকাশের পর জিপিএ-৫ নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে উচ্চমাত্রায় উচ্ছাস, আনন্দ ও উদ্দীপনা প্রকাশ পায়। অভিভাবকসহ অনেকেই এ আনন্দ প্রকাশ করছেন। ভাল ফলাফলের জন্য অবশ্যই শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন বা উৎসাহ দেওয়া যায়, দিতে হয়। কিন্তু এ আনন্দ, অতি প্রশংসা বা উৎসাহের মাধ্যমে কি শিক্ষার্থীদেরকে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে না? কারণ এর মাধ্যমে তাদের কাছে একটা বার্তাই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, আগামীর যে কোনো পরীক্ষায় তার জিপিএ-৫ পাওয়া ছাড়া কোনো গত্যান্তর নেই। জিপিএ-৫ পাওয়া ছাড়া তার জীবন বৃথা, কোন উন্নতি করতে পারবে না। এর ফলে আগামীর একাডেমিক জীবনের লক্ষ্যই যেন হয়ে ওঠবে এই জিপিএ-৫। বলা যায়, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিভাবকরাই কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদেরকে পরোক্ষভাবে এক অসম ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঠে নামিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা ক্রমে হয়ে ওঠছে জিপিএ-৫ পাওয়া নির্ভর মেধাবী।

মেধার অন্যান্য শাখাগুলো তাদের ধ্যান-ধারণায় থাকছে না। তাহলে কি অভিবাবকরা নিজের অজান্তেই নিজের আদরের সন্তানকে ভুল তথ্য দিয়ে ‘ভুল মেধাবী’ হওয়ার পথে পাঠাচ্ছেন? আমার সন্তানকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে- এমন মানসিকতা লালন করা কতটুকু সমীচিন, তা চিন্তা করা উচিত।
তিন. এক শ্রেণীর অভিভাবক আছেন, যারা হন্য হয়ে জিপিএ-৫ এর পেছনে ছুটেন। সঙ্গে শিক্ষার্থীকেও ব্যস্ত রাখেন। এ জাতীয় মানসিকতা লালন করেন এমন অভিভাবকের সংখ্যা মোটেও হাতেগুণা নয়। কিন্তু প্রশ্নটা হলো- জিপিএ-৫ কি মেধার, ভাল শিক্ষার্থী হওয়ার কিংবা সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করার প্রধান মাপকাঠি? ভাল এবং মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ার অনেক সুচক আছে, কেবল জিপিএ-৫ নয়। আরো অনেক সুচকের দিকে মনযোগ না দিয়ে কেবল জিপিএ-৫ নিয়ে অসম প্রতিযোগিতা করার হীন মানসিকতা চর্চা করা কোনো মতেই উচিত নয়।

কারণ এ চিন্তা চেতনায় শিশু শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে বলে মনে হয় না। লেখাপড়ায় জিপিএ-৫ শেষ কথা নয়। তাছাড়া কেবল সংখ্যা ভিত্তিক ও পরীক্ষা নির্ভর মূল্যায়ন দিয়ে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা সম্ভব নয়। বরং শুনা, বুঝা, বলা, পড়া ও লেখা- এ পাঁচটি বিষয়েও শিশু শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর আনন্দময় পরিবেশও নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। অন্যথায় কেবল জিপিএ-৫ এর পেছনে ছুটলে সন্তান হয়তো কাঙ্খিত ফল পাবে না। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কতটুকু মেধাবী শিক্ষার্থী হতে পেরেছে, সেটা ভাবা দরকার।
চার. যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, বর্তমানে যে সকল সফল মানুষ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত কিংবা আপন কর্মস্থলে আলো ছড়াচ্ছেন, তারা কি সবাই প্রতিটি শ্রেণীতে প্রথম ছিলেন? তারা কি কথিত গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিল? এখন যে সকল শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে না, তারা কি কেউ উচ্চ শিক্ষিত হবে না? তাদের কেউ কি বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে না? তাহলে কেনইবা এই জিপিএ-৫ নিয়ে এত মাতামাতি? এত ছুটাছুটি।
অথচ এমন দৃষ্টান্তও আছে যে, পিইসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি- এ চারটি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পরও মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ভাল কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি বা ভাল বিষয় পাইনি। তাহলে তারা কি খারাপ শিক্ষার্থী?

প্রকৃত পক্ষে দোষ তাদের নয়, বরং দোষ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়, শিক্ষা পদ্ধতিতে, সঙ্গে অভিভাবকদের মানসিকতার। আমাদের সন্তানদের বুঝানো উচিত যে, জিপিএ-৫ পাওয়াটাই শিক্ষার আসল মানদন্ড বা সফল শিক্ষার্থীর মাপকাঠি নয়। বেসিক শিক্ষায় শিক্ষা নেওয়াটা এবং শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় দক্ষ হয়ে ওঠাই মূল কথা। শিক্ষার বিভিন্ন সূচকেও শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলার বিষয়টিকে অভিভাবকদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
পাঁচ. একজন শিক্ষার্থী রাতদিন সময়-শ্রম দিয়ে পড়ালেখা করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু ঘটনাক্রমে আকাংঙ্খিত ফল পেল না। এখন তার মনের অবস্থা কী হবে, তা কি আমরা কখনো চিন্তা করে দেখেছি।

অথচ গত ৩১ ডিসেম্বর (২০১৯) প্রকাশিত পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল না পেয়ে ২ জানুয়ারি (২০২০) রাত ১২টা পর্যন্ত সারাদেশে ১৩ জন ফলপ্রার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর পর আসা যাক, জিপিএ-৫ পাওয়ার পর যে সব শিক্ষার্থী তার কাক্সিক্ষত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না পায়, তাহলে তার মনের অবস্থাটাও কেমন হতে পারে? এখন প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, এতগুলো জিপিএ-৫ পাওয়া কি তাহলে ভুল ছিল? শিক্ষার্থী কি ভুল পথে ছিল? কেন ভাল কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পারল না? কেন ভাল বিষয় তার ভাগ্যে জুটেনি? এতসব বিষয় অভিভাবকদের চিন্তা করা দরকার এবং এখনই। প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ছেলেমেয়ের আত্মহননের সংবাদ কি আমাদের এতটুকুও উদ্বেলিত করে না? অভিভাবক-শিক্ষকদের চাপ দেওয়ার প্রবণতাটা কি আত্মহত্যার নেপথ্য কারণ ছিল না?
শিশুদের ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বিষ খাওয়া বা গলায় দঁড়ি দেওয়ার পেছনে কি পরিবারের অপ্রত্যাশিত ভূমিকা ছিল না? অতএব, আর নয়, শিশুদের জিপিএ-৫ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা, বন্ধ হোক অপ্রত্যাশিত চাপ। সুযোগ দেওয়া হোক শিশু শিক্ষার্থীদের নিজের মত করে লেখাপড়া করার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট