চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

গণিতশাস্ত্রবিদ মুসা আল খোয়ারিজ্মী

জহিরুদ্দীন মো. ইমরুল কায়েস

১৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বিজ্ঞানের যে আজ অভাবনীয় উন্নতি, এর পেছনে রয়েছে বহু বিজ্ঞানী আর গণিতবিদদের অবদান। এসব মনিষীদের প্রত্যক্ষ অবদান ব্যতীত জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ পর্যায়ে আসা কখনো সম্ভব হতো না। একটু ভাবুন, এয়ারক্রাফট যোগে হাজার হাজার ফিট উপরে উঠে শূন্যে কয়েকশ মাইল বেগে দ্রুত ধাবিত হওয়ার সময় এয়ারক্রাফটের ভারসাম্য থাকার পিছনে রয়েছে গণিতের জটিলতর সব হিসাব নিকেশ। সেভাবে রকেট পরিচালনা, কম্পিউটার-মোবাইল সঞ্চালন, রোবোটিক কলকারখানার বিষম যন্ত্রপাতি গুলোর পরিপূর্ণ কার্যকরী হওয়া বা সামরিক ইক্যুয়িপমেন্টসমুহ বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে গাণিতিক পরিগণনা। গণিত কে মাদার অব অল সায়েন্স বলা হয় । পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা আর জীব বিদ্যার আসল রূপও গণিত। সেই জটিল হিসেব নিকেশের বাস্তবিক কর্মসম্পাদনের সঠিক প্ল্যাটফরম হলো বীজগণিত। আর সেই আলজেবরা বা বীজগণিতের জনক হলেন মুসা আল খোয়ারিজমী। তাঁর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মুসা আল খোয়ারিজমী।

তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়া দ্বীপের নিকট খোরাজম নামক শহরে ৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। এ এলাকাটি বর্তমানে উজবেকিস্থানের নিয়ন্ত্রণে। খলিফা আল মামুনের আনুমানিক ১৪ বছর পর ৮৫০ খ্রীষ্টাব্দে আবু মুসা আল খোয়ারিজমী মৃত্যুবরণ করেন। খোরাজম শহর প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল। মুসলমানেরা পারস্য বিজয়ের পর বাগদাদ শহর ব্যবসা-বাণিজ্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠে। জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরা জ্ঞান চর্চার জন্য বাগদাদ শহরে ভিড় করতে থাকে। আল খোয়ারিজমীও হয়ত এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। আল খোয়ারিজমী খলিফা আল মামুনের বায়তুল হিকমাহ (ঐড়ঁংব ড়ভ ডরংফড়স) লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। খলিফা মামুনের মৃত্যু পরবর্তী খলিফা আল ওয়াতহিকের শাসনকালের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। আল খোয়ারিজমী তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থ ৮১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচনা করেছেন বলে মনে করা হয়। বীজগণিত হল ইসলামী সভ্যতায় তাঁর শ্রেষ্ঠতম অবদান। বীজগণিতকেই তিনি বিশেষ মর্যাদাবান আসনে অধিষ্ঠিত করেন। তাঁর রচিত পুস্তক ঞযব পড়সঢ়বহফরড়ঁং নড়ড়শ ড়হ পধষপঁষধঃরড়হ নু পড়সঢ়ষবঃরড়হ ধহফ নধষধহপরহম বা কিতাব আল জাবর আল মুকাবালা হতে বীজগণিতের ইংরেজী নাম আলজেবরা (অষমবনৎধ) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এই বইটি রচিত হয়। এই বইটির মূল কপি বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। আটশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত জ্ঞান বিজ্ঞান প্রসারিত করার ক্ষেত্রে ইসলামের স্বর্ণযুগ ছিল। সে সময়কালের প্রথম দিকেই মুসা আল খোয়ারিজমী তাঁর গাণিতিক গবেষণা কর্মগুলো সাধিত করেন। মুসা আল খোয়ারিজমীকে ইসলামের বৈজ্ঞানিক স্বর্ণযুগের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে মনে করা হয়।
গণিত শাস্ত্রে মুসা আল খোয়ারিজমীর অবদান কতটুকু তা তাঁর কিছু গাণিতিক ব্যাখ্যায় কিঞ্চিৎ আন্দাজ করা যায়। এ্যালজেবরা শব্দটির ধারণা এসেছে দ্বিঘাত সমীকরণ থেকে। কোয়াড্রাটিক ইকুয়েশন [যার প্রমিত রূপ ধী২+ নী + প = ০] সমাধানের জন্য তাঁকে বীজগণিতের জনক বলা হয়। আজ থেকে দু’হাজারেরও বেশী বছর আগে ০৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় গণিতবিদগণ সংখ্যা গণনায় দশমিক পদ্ধতি আবিস্কার করেন।

আর এই দশমিক পদ্ধতি বিশ্ব দরবারে পরিচিত করান আল খোয়ারিজমী তাঁর লিখা কিতাবুল জাম ওয়াল তাফরিক ফি হিসাব আল হিন্দ (যোগ বিয়োগে ভারতীয় পদ্ধতি) বইয়ের মাধ্যমে। সুপ্রাচীনকালে গণিত বলতে শুধু পাটিগণিতকে মনে করা হতো। কিতাব আল জাবর আল মুকাবেলা প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষ গণিতের আরেকটি প্ল্যাটফরমের সাথে পরিচিত হয়। খোয়ারিজমী তাঁর বইয়ে কোয়াড্রাটিক ইকুয়েশনকে মোট ০৬টি ভাগে ভাগ করান।
এখানে উল্লেখ্য যে, মুসলিম গণিতবিদগণ নেগেটিভ পয়েন্ট নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন না। খোয়ারিজমীর বইয়েও সেরকম নেগেটিভ সাইনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ‘আল-জাবর’ হলো কোনো ইকুয়েশনের উভয় পাশে সমান ভ্যালুর এলিমেন্ট যোগ করার মাধ্যমে কোন নেগেটিভ স্কয়ার, রুট বা নাম্বার বাদ দেওয়ার পদ্ধতি। যেমন ী২ = ৪০ী – ৪ ী২ ইকুয়েশনের উপর ‘আল জাবর’ ম্যাথড চালালে পাওয়া যাবে ৫ী২ = ৪০ী । আর আল মুকাবালা হল কোন এক ইকুয়েশনের একপাশ থেকে আরেকপাশে একই রকম এলিমেন্টগুলোকে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি। যেমন ী২ + ৮ = ৫০ী + ৭ী২ এর উপর আল মুকাবালা প্রক্রিয়া চালালে পাওয়া যাবে ৮ = ৫০ী + ৬ী২ । এরকম আরো নানান পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন মহান এ গণিতবিদ।

শুধু ‘ফাদার অব আলজেবরাই’ তিনি নন। কম্পিউটার বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ‘আলগরিদম’ পদ্ধতিটির আবিস্কারকও মুসা আল খোয়ারিজমী। তাঁর নামের “আল খোয়াজরিজমী” অংশটি থেকে “আলগরিদম” শব্দটি এসেছে। আল খোয়ারিজমী গণিতে আলগরিদমের ধারণা বিকশিত করেছিলেন। সে কারণেই কম্পিউটার বিজ্ঞানের বহু বিদগ্ধ ব্যক্তি তাঁকে ‘কম্পিউটার বিজ্ঞানের পিতামহ’ বলে অভিহিত করেন। যাঁরা কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করেন তাঁরা বলতে পারবেন আলগরিদম ছাড়া বাস্তবে কোন প্রোগ্রামিং কোড লেখা সম্ভব কিনা। সি++, জাভা, ভিবিস্ক্যৃাপ্ট, এএসপিসহ সকল অবজেক্ট অরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং এবং হাই লেভেল ল্যাংগুয়িজ এ আলগরিদম মানা আবশ্যকীয়। প্রোগ্রামিং এর মূল ভিত্তিই হলো আলগরিদম। মুসা আল খোয়ারিজমী র্জ্যোতিবিজ্ঞান নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন। নির্ভুল ক্যালেন্ডার তৈরি, চাঁদ, সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান গণনা, ত্রিকোনোমিতির সাইন, টেনজেন্ট টেবল, চাঁদের দৃশ্যমণ্যতা নিয়েও দিয়ে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। তাঁর তৈরি সূর্য ঘড়ি ছিল সার্বজনীন। পৃথিবীর সর্বজায়গায় তাঁর ঘড়িটি নিখুঁতভাবে কাজ করতো। তিনি পৃথিবীর মানচিত্রও অঙ্কন করেন। আশ্চর্য হলেও সত্যি স্প্যানিশ গুয়ারিজমো এবং পর্তুগিজ এলগারিজমো শব্দদুটোর অর্থ – সংখ্যার একক বা ডিজিট। যেটি এসেছে তাঁর নাম থেকেই! খোয়ারিজমী ধারণা দেন যে শূন্য বা ‘০’ হলো একটি পরিপূর্ণ নাম্বার। তিনি নির্ভূলভাবে মুসলিম শরিয়া অনুসারে উত্তরাধিকার সম্পত্তি গণনা করেন। এছাড়াও তিনি ভূগোলের সংমিশ্রণে বিশ্বের ২৪০০টি নগর/শহরের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ তালিকাবদ্ধ করেন। দশমিক পদ্ধতিরও উদ্ভাবক বহুমুখী প্রতিভাদর চির শাশ্বত এ গণিতবিদের।

আজ থেকে ১২০০ শত বছর আগে খোয়ারিজমী অঙ্ক গণনার যে পদ্ধতি চালু করেন সে প্রথা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবসাপাতির কাজে-কর্মে ব্যবহারসহ মহাজটিল মহাকাশ বিজ্ঞানেও ব্যবহার হচ্ছে। কালের পরিক্রমায় আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মুসা আল খোয়ারিজমী’র নাম উচ্চারিত না হলেও তাঁর রেখে যাওয়া কর্ম হয়ত রয়ে যাবে অনন্তকাল। কর্মই মানুষকে অমর করে। মুসা আল খোয়ারিজমী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট