চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শুদ্ধ সমাজ গঠনে শুদ্ধ ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

১৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ধর্মীয় উপদেশের জন্য আহুত সমাবেশকে ওয়াজ মাহফিল বলা হয়। মিলাদ মাহফিল, তাফসীর মাহফিল, দাওয়াতি মাহফিল, দ্বীনি জলসা ইত্যাদি নামে ধর্মীয় সমাবেশ করা হয়। যেখানে যে নামে আখ্যায়িত করা হোক না কেন, এর মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য একই। অর্থাৎ মানুষকে পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বয়ান শুনিয়ে সত্য পথে আনা এবং সে পথে অবিচল থাকার দীক্ষা দেয়া। যুগ যুগ ধরে এদেশে ওয়াজ মাহফিল প্রচলিত আছে। ধর্মীয় বাণী শুনিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিধি-বিধানের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণই (গড়ঃরাধঃরড়হ) এর মূল উদ্দেশ্য। ইসলামী বিধান অনুসারে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাযের পূর্বে খুতবা তথা ধর্মীয় বক্তব্য প্রদান করা ও শুনা ওয়াজিব। এতে খতিব সাহেব সমসাময়িক বিষয় নিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন। রাসুলুল্লাহ (দ.) প্রতি জুমাতে খুতবা দিতেন। দুই ঈদের দিনেও খুতবা দিতেন। বিভিন্ন সফর, অভিযান, ঘটনার প্রেক্ষিতে খুতবা দিতেন। অতএব জুমার দিনের খুতবা ওয়াজিব এবং বিভিন্ন দিবস ও উপলক্ষে খুতবা দেয়া সুন্নাত।

সর্বসাধারণকে সৎকর্মের সুফল এবং যাবতীয় বদ আকিদা ও অপকর্মের কুফল সম্পর্কে সতর্ক করার ক্ষেত্রে জুমার খুতবা জরুরি। এ ওয়াজ কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষ ইসলাম সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং এর মাধ্যমে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে এমন একটি গোষ্ঠী হওয়া চাই, যারা কল্যাণের পথে আহবান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে আর অসৎ কাজ থেকে বারণ করবে” (সুরা আলি ইমরান: ১০৪)। আরো বলা হয়েছে, “হে রাসুল, আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা আপনি পোঁছিয়ে দিন” (সুরা মায়িদা: ৬৭)।
ওয়াজ মাহফিলের উপকারীতা অনস্বীকার্য। কারণ, নৈতিকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হলো ওয়াজ মাহফিল। যুগে যুগে আল্লাহর নবি-রাসুল ও পীর-আওলিয়া দ্বীনের তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজ করেছেন। তাঁদের দাওয়াতের বড় কর্মসূচি ছিল ওয়াজ মাহফিল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “আপনি উপদেশ দিন। কেননা, উপদেশ বিশ্বাসীদের উপকারে আসে” (সুরা আয-যারিয়াত: ৫৫)। তবে খুতবার জন্য ইসলামি শরিয়ায় কিছু নির্দিষ্ট নীতি আছে। খতিবের জন্যও আছে কিছু শর্ত। বক্তার জন্য তথ্য, ভাষা, উপস্থাপনাগত কিছু যোগ্যতা প্রয়োজন।

ধর্মীয় বক্তার অন্যতম যোগ্যতা হলো, কথার সাথে নিজের কাজের মিল। যিনি সুবক্তা, কিন্তু নিজে আমলদার না; তার বক্তব্যে স্থায়ী প্রভাব থাকে না। মানুষ হেদায়াত প্রাপ্ত হয় না। নিজে যা আমল করে না, তার উপদেশ দেয়া আল্লাহর নিকট বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। বলা হয়েছে, “হে ইমানদারগণ, তোমরা তা কেন বল, যা তোমরা কর না? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর নিকট বড় ঘৃণিত কাজ” (সুরা আছ-ছাফ্: ২-৩)। বক্তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ইখলাছ বা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বক্তব্য প্রদান করা। পার্থিব যশ-খ্যাতি, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বা অন্য কিছু ধর্মীয় বক্তার উদ্দেশ্য হতে পারে না। তবে শিক্ষকতার ন্যায় ওয়াজ মাহফিল করে হাদিয়া গ্রহণ করা নাজায়েয নয়, যদিও উত্তম হলো এর কোন বিনিময় গ্রহণ না করা। কারণ, বিনিময়হীন ওয়াজের প্রভাব পড়ে বেশি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা অনুসরণ করো তাদেরকে, যারা তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চায় না। অথচ তারা হিদায়াত প্রাপ্ত” (সুরা ইয়াসীন: ২১)। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, “কিছু বক্তৃতা যাদুর ন্যায়” (ছহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫১৪৬)। অর্থাৎ যাদু যেমন মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে তেমনি বক্তৃতাও মানুষকে প্রভাবিত করে। ড. ইকবাল বলেন, “যে কথা হৃদয় থেকে বের হয় তা কিছু না কিছু প্রভাব ফেলবেই” (কুল্লিয়াতে ইকবাল)। ভাল বক্তার নিষ্ঠাপূর্ণ বক্তব্য যেমন ভালো প্রভাব ফেলে তেমনি ভুল, বিভ্রান্তিকর, কাঁদা ছোড়াছুড়িমূলক বক্তব্য সমাজের মধ্যে বিশৃংখলা, অনৈক্য, হানাহানি সৃষ্টি করে। যেমন বর্তমানে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে।

মতবিরোধ থাকাটা স্বাভাবিক। যে কোন মতবাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভিন্নতা আসাটাও অস্বাভাবিক নয়। মুসলিম উম্মাহও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হবে বলে পবিত্র হাদিসে ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, আমাদেরকে বিভক্তির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে; বরং বিভক্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কারণ, ধর্মীয় মতবিরোধ খুবই মারাত্মক, যার কারণে ইতিপূর্বে আদম সন্তানকে বড় খেসারত দিতে হয়েছে। বর্তমান মুসলিম সমাজও এর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক খেসারত দিচ্ছে। এ মতবিরোধ ইতিপূর্বে ছিল না- এমনটি নয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের ফলে পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোতে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে নিজের মতের পক্ষের বা বিপক্ষের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে। সাথে সাথে সে বক্তব্যের চর্চা শুরু হয়ে যাচ্ছে। আর ঝগড়া লেগে যাচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না” (সুরা আলি ইমরান: ১০৩)। লক্ষ-কোটি টাকার চ্যালেঞ্জ, জ্ঞানের অহংকার, অন্য বক্তাকে ব্যঙ্গ করা, নাম বিকৃত করা, কথায় কথায় বিদয়াত, শিরক, কুফর-এর মত মারাত্মক ফতোয়া প্রদান, হাদিয়া নিয়ে দরাদরি, অগ্রিম হাদিয়া দাবি, দাওয়াত নিয়ে না আসা, একদিনে একাধিক মাহফিল নিয়ে যথাসময়ে আসতে না পারা, বক্তব্যের মধ্যে কুরআন-হাদিসের কথার চেয়ে অন্যকিছু বেশি চর্চা, অপরের সমালোচনায় সময় পার করা, দীর্ঘপথ পর্যন্ত মাইক টাঙ্গিয়ে রাতদুপুরে বিকট আওয়াজে বক্তব্য প্রদান ইত্যাদির কারণে ওয়াজ মাহফিল অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু সত্য-মিথ্যা বা হকÑনাহক, ভাল-মন্দ বুঝার জন্য মাহফিলের আয়োজন করা হয় সেহেতু সত্যটা উপস্থাপন করা আর ভুলটা চিহ্নিত করা বক্তার দায়িত্ব বটে। তবে অমার্জিত ও অশালীন ভাষা ব্যবহার করার মাধ্যমে নয়, যা এখন প্রতিনিয়ত চলছে। পবিত্র কুরআনে হিকমত তথা প্রজ্ঞার সাথে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করতে বলা হয়েছে। অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে পবিত্র হাদিসে। এমনকি যে মূর্তিপূজা ইসলামে সবচেয়ে বড় পাপ, সে মূর্তিগুলোকেও গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো পূজা করে। তখন তারা বাড়াবাড়ি ও মূর্খতাবশত গালি দেবে আল্লাহকে। আমি প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর জন্য তাদের কার্যকলাপকে শোভন করে দিয়েছি” (সুরা আনআম: ১০৮)। একবার এক অমুসলিম এসে ভাষাগত চালাকির আশ্রয় নিয়ে সালাম দেয়ার ছলে বলল, “হে মুহাম্মদ তোমার মৃত্যু হোক”। তখন হযরত মা আয়েশা (র.) তার প্রতিউত্তর দিলেন। আল্লাহর নবি (দ.) বললেন, “হে আয়েশা, থাম, নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল বাক্য ও কাজকে পছন্দ করেন না” (ছহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১১)। অতএব ওয়াজের নামে পরচর্চা, গালিগালাজ, অন্যের সম্মানহানি মোটেই কাম্য নয়। বিরোধীমতের বক্তাকে খন্ডন করতে গিয়ে এমন উপস্থাপনা কিছু শ্রোতার নিকট সাময়িকভাবে তৃপ্তিদায়ক হলেও সচেতন মানুষের নিকট ঘৃণিত। সচেতন শ্রোতারা চান যে, অন্তত ধর্মীয় বক্তরা ইতিবাচক, আবেদনমূলক ও দলিলভিত্তিক কথা বলুক। যে বক্তব্য দ্বারা ঐক্য, শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সেজাতীয় কথা বলুক। কিচ্ছা-কাহিনীনির্ভর না হয়ে জীবনঘনিষ্ট বিষয়ে যুগোপযোগী বক্তব্য পেশ করুক। ভিন্ন মতবাদীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিজের মতে যা সত্য তা উপস্থাপন করুক। পবিত্র কুরআন-হাদিস ও গ্রহণযোগ্য মনীষীদের মন্তব্য পেশ করুক।

“আমিই সবজান্তা” মানসিকতা নিয়ে বক্তব্য দেয়াও বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। বিশেষত প্রশ্নোত্তর পর্বে কেউ বলেন না যে, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। অথচ ইমাম মালিককে পঁয়তাল্লিশটি প্রশ্ন করা হলে তিনি বত্রিশটির উত্তরে বলেছেন, “আমি জানি না”। ইমাম গজ্জালির মতে, জ্ঞানচর্চায় যিনি এমন বিনম্্র তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। আবার শ্রোতাদের একটি অংশের মানসিকতা হলো, যিনি তার মতের পক্ষে উলঙ্গভাবে কথা বলবেন আর বিপরীত মতের বক্তাকে অশ্লীল ভাষায় ধোলাই করবেন তিনিই ভাল বক্তা। এমন বক্তার পক্ষে শ্লোগান পড়ে বেশি। বক্তাও খুশিতে ভাসে আর সীমালঙ্ঘন করে বসে। পরের দিন আসে ফতোয়া। এভাবে অধিকাংশ ওয়াজ মাহফিল যেন হয়ে যাচ্ছে একেকটি বিতর্ক ও প্রতিবাদ সভা। বক্তব্যের ভাষা ও শৈলী তেমনই। এতে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আত্মতৃপ্তির খোরাক হলেও ক্ষতি হচ্ছে পবিত্র ধর্ম ইসলামের। সম্মান কমছে আলেম সমাজের। একে অপরকে ছোট করতে গিয়ে নিজেই হেয় হয়ে যাচ্ছে সাধারণের চোখে। “ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়” নীতির শিকার হচ্ছে প্রত্যেকেই। অযৌক্তিক সমালোচনার পরিণতি এমনই হয়ে থাকে।

আল্লাহর নবি (দ.) বলেন, “তুমি যখন মানুষের দোষ খুঁজবে তখন তারা তোমাদের দোষ খুঁজবে” (মুয়াত্তা, হাদিস নং-৭৮৯)। অতএব দোষাদোষির বক্তব্য পরিহার করে আবেদনমূলক বক্তব্য পেশ করে কুরআন-হাদিস ও গ্রহণযোগ্য মনীষীদের উক্তি উদ্ধৃতি করার মাধ্যমে শালীন ভাষায় বক্তব্য প্রদান করলে মানুুষ সঠিক পথের দিশা পাবে। সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য দলিলহীন, বাস্তবতা বিবর্জিত আর শুধু আবেগনির্ভর বক্তব্য পরিহার করতে হবে। যেমন, “ঠিক না বেঠিক” পরিভাষা দিয়ে শ্রোতাদের সম্মতি নেয়া এবং মাঠ গরম করার প্রবণতা। তারা তো “ঠিক না বেঠিক” বলার কেউ না; যদিও তারা বক্তার মোড বুঝে ঠিক বা বেঠিক বলে ফেলেন অবলীলায়। এতে মাহফিলের ভাবগাম্ভির্য বিনষ্ট হয়। হালকা হয়ে যায় দ্বীনি বিষয়।

সে সুবাদে ইউটিউবসহ সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে দেখা যায় অমুককে ধোলাই দিয়েছেন অমুক অথবা দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন অমুক ইত্যাদি। এমনকি এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য টুকরো টুকরো বাক্য, বিকৃত ছবি পোস্ট করে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছে। অতএব ওয়াজ মাহফিলের নামে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করা, লাগামহীন ও অশালীন ভাষা ব্যবহার করা মোটেই কাম্য নয়। আপনার বক্তব্যটা আপনি পেশ করুন, তখন বিপরীত মতটি ভুল প্রমাণিত হবে। আর পরস্পরের দূরত্বের জায়গাগুলো বেশি খোঁজাখুঁজি না করে মিলের জায়গাগুলো খুঁজতে চেষ্ট করুন। বিশ্বপ্রেক্ষাপটে আন্তধর্মীয় মিল খুঁজার মধ্য দিয়ে যখন বিশ্বসম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ চলছে, তখন স্বধর্মের পথপ্রদর্শকদের এত মতবিরোধ ও বাড়াবাড়ি লজ্জাকর বৈ কি!

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট