চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

এসডিজি অর্জনে প্রাথমিক শিক্ষা

মোহাম্মদ রুহুল আমীন

১৬ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় গত এক দশকে অভাবিত অগ্রগতি হয়েছে। ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে অগ্রগতিগুলো। প্রাথমিক শিক্ষার এই দৃশ্যমান সাফল্য দেশেরই একটি বড় অর্জন। এর শুরুটা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। ১৯৭৩ সালে তিনি ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়।
এর মাধ্যমে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ হয়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নে গত এক দশকে সরকারের নানামুখী সুদূরপ্রসারি উদ্যোগের ফলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার নানা ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে আছে, প্রধান শিক্ষকদের পদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা, সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীত করা, ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগ করা, শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসম্মত পাঠদানের উপযোগী-দক্ষ করে গড়ে তোলা, এক বছরের সিইনএড’ (সিইনএড কি?) প্রশিক্ষণ কোর্স পরিবর্তন করে দেড় বছরের ডিপিইনএড কোর্স যুগোপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মত চমৎকার এবং যুগোপযোগী সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষক সংকট নিরসনে ‘পুল প্যানেল’ শিক্ষক ছাড়াও লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
১০ বছর আগেও প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা মূলধারায় ছিল না, মূলত সেটি সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সন্তানদের মধ্যেই। ইংরেজি মাধ্যম বা কিন্ডারগার্টেনেই কেবল প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হতো। এখন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে মোট ৩৭ হাজার ৬৭২টি প্রাক-প্রাথমিকের পদ সৃজন করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’র ৪ দশমিক ২ এ ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে-মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যের সঙ্গে সরকারের কার্যক্রম সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে।
দুই. সরকার নারীবান্ধব নানা উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। ফলে সমাজের নারীরা আজ পরিবারের পাশাপাশি বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় নিজেদের সক্রিয় ভূমিকা জোরদার করে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় কর্মরত মোট ৫ লাখ ২৭ হাজার ৭৯৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩ লাখ ১৪ হাজার ২৯৯ জন নারী শিক্ষক, অর্থাৎ বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬৩ দশমিক ১৭ শতাংশই নারী শিক্ষক। নিকট অতীতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অর্ধেক নতুন আর অর্ধেক পুরাতন বই দেওয়া হতো। বছরের পর বছর পুরাতন বই দেওয়ার ফলে বইয়ের ভেতরে অনেক পাতার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু সরকার ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি প্রাক-প্রাথমিক এবং ইবতেদায়ি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে আকর্ষণীয় রঙিন বই পৌঁছে দিচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এটি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখন বছরের প্রথম দিনটি সারাদেশে ‘বই উৎসব’ হিসাবে পালিত হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রাথমিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা এবং ধরে রাখা।

কিন্তু সময়ের কঠোর এবং কঠিন বাস্তবতা মোকাবেলায় সরকার সারাদেশে উপবৃত্তি চালু করেছে। সকালে শিশুকে, দুপুরে মায়ের হাতের রান্না করা খাবার টিফিন বক্সে আনার জন্য ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দারিদ্রপীড়িত এলাকায় ‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্পের আওতায় ১০৪টি উপজেলায় ১৫ হাজার ৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫ গ্রাম ওজন বিশিষ্ট পুষ্টিমান সমৃদ্ধ বিস্কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ নানা সহপাঠ কার্যক্রম আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘ক্লাব দল’ গঠন করা হয়েছে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধনে প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখন পূর্বের তুলনায় খেলাধুলার প্রতি মেয়েদের আগ্রহ এবং অংশগ্রহণ দুটোই বেড়েছে।
দেশের বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় এক হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে এক হাজার ৪৯৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৩ (প্রাইমারি এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট-৩) এর আওতায় নতুন শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ, সুপেয় পানিয় জলের ব্যবহারের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, ওয়াশ ব্লক নির্মাণ, টয়লেট মেরামত, বিদ্যালয়ের রুটিন মেরামত, অবকাঠামোর বড় সংস্কারসহ ইত্যাদি নানা ধরণের কাজ সম্পাদন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে প্রায় পৌনে এক লাখ শিক্ষককে।

শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যোগসূত্র অন্যতম। এই যোগসূত্র অর্জিত না হলে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার- এ দুই ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জকে যদি মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে মানসম্পন্ন শিক্ষার সঙ্গে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সমন্বয় করার কোনো বিকল্প নেই। প্রাথমিক স্তরে পাঠক্রমে যুক্ত হয়েছে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’।

বিদ্যালয় পর্যায়ে ‘স্লিপ ফান্ডে’র বরাদ্দ ৪০ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে ২২ হাজার ১৭৫টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পাঁচ হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মডেম এবং সাউন্ড সিস্টেম সরবরাহ করা হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঠদান করতে ওঈঞ রহ ঊফঁপধঃরড়হ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ৬৪ হাজার ৭০৫ জন শিক্ষককে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’র ৪ দশমিক ১ এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ‘২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে ও মেয়ে যাতে প্রাসঙ্গিক, কার্যকর ও ফলপ্রসূ অবৈতনিক, সমতাভিত্তিক ও গুণগত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে তা নিশ্চিত করা।’ সরকারের উপরোল্লিখিত উদ্যোগ আর এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা যেনো একে অপরের পরিপূরক। এভাবেই সরকারের গৃহীত শিক্ষাবান্ধব নানা পদক্ষেপ মাঠ পর্যায়ে যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন তরান্বিত হবে। অর্জিত হবে টেকসই উন্নয়ন। এগিয়ে যাবে দেশ। সমৃদ্ধি হবে দেশের শিক্ষা। তৈরি হবে দক্ষ জনবল। প্রজন্ম হবে শিক্ষিত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট