চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু টানেল

ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু

১৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:০১ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি জাপান ভ্রমণকালে দেশটির অ্যাকোয়া টানেল দেখার সুযোগ মিলেছে। খুব কাছ থেকে দেখা হয়েছে সেই টানেল। টানেলটি টোকিও বে অ্যাকোয়ালাইন নামেও পরিচিত। টোকিও বে’র মধ্য দিয়ে ১৫.১ কিলোমিটার সামুদ্রিক পথ রয়েছে, যা বোসো উপদ্বীপে চিবা প্রদেশের কিসারাজু সিটির সাথে কানাগাওয়া প্রদেশের কাওয়াসাকি সিটির সাথে সংযোগ স্থাপন করে। কাওয়াসাকি থেকে কিসারাজু যেতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে। হাইওয়েটি প্রধান দুটি শিল্পঞ্চলকে এক করে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। এই টানেলটি দিয়ে আমারও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাতায়াত করেছি বুঝতেই পারিনি। কি সুন্দর!
টানেলটির দৈর্ঘ্য ৯.৫ কিলোমিটা। এই টানেলের মাধ্যমে যেহেতু কয়েকটি এলাকাকে সংযুক্ত করা হয়েছে সেহেতু এই পথগুলোর মাঝখানে একটি বৃহৎ টুরিস্ট স্পট রয়েছে। এই স্পটের আকৃতি সম্পূর্ণ জাহাজের মতো। সেখানে রয়েছে গাড়ী পার্কিংয়ের স্থান, যাত্রীদের বসার জায়গা, বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট, নানা রঙ্গের ফুলের বাগান, এমনকি একটি জাহাজের ড্রাইভিং হুইলের ডামিও রয়েছে সেখানে। দূর থেকে এই স্পটটি দেখলে মনে হবে যেন সমুদ্রের বুকে বিচরণরত এক জাহাজ। সত্যি অদ্ভুত এক নির্মণশৈলী। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। জাপান আমাদের তুলনায় অনেক দূর এগিয়ে। তাদের কাজ আমাদের চেয়ে আরও সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন। এই স্থানটি তার উদাহারণ। রাতের আলোতে সর্ম্পূণ ভিন্ন রকম রূপ ধারন করে দিনের তুলনায়।

যদি এটার সঙ্গে আমাদের চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেলের বিশ্লষণ করি তাহলে আমাদের টানেলটি আরও সুন্দর দৃষ্টিনন্দন বলতে হবে।
কর্ণফুলী নদীর নেভাল একাডেমি থেকে আনোয়ারা প্রান্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য সোয়া তিন কিলোমিটার। এই দৈর্ঘ্যটুকুকে এখন চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্নের সমান বলা যায়। এখানেই নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীর দিয়ে চলবে সারি সারি গাড়ি। সে লক্ষ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে দেশ তথা সার্কের প্রথম টানেল সড়ক। এখনও সেখানে চলছে কর্মযজ্ঞ। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২২ সাল নাগাদ টানেল নির্মাণ শেষে গাড়ি চলাচল শুরু হবে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি এসেছিল ২০০৮ সালে। চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রতিশ্রুতি দেন। বাংলাদেশের জন্য ‘প্রায় অসম্ভব’ মনে করে বিষয়টিকে ‘শুধুই জনসভার প্রতিশ্রুতি’ হিসেবে ভেবেছে অনেকেই। তবে ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলে হাসি ফোটে সবার মুখে। দূর হয় সব শঙ্কা। এরপর জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণকাজে অর্থছাড় করাতে যতটুকু সময় লাগে, ততটুকুই। এর পরই শুরু হয় নির্মাণকাজ।

ভারতে সড়ক যোগাযোগে স্থলভাগে টানেল থাকলেও নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম। মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত ৫০৮ কিলোমিটার হাইস্পিড রেল করিডর নির্মাণ করার পরিকল্পনা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করেছে ভারত। এরই মধ্যে ২১ কিলোমিটার সাগরের নিচ দিয়ে টানেল থাকবে। জাপানের সহায়তায় কাজটি চলতি বছরের শেষ দিকে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২২ সালে। তবে এটিও রেল টানেল। সে হিসেবে বাংলাদেশই নদীর তলদেশে সড়ক টানেল নির্মাণে সার্কের মধ্যে প্রথম হতে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলির নদীর নিচে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল নির্মাণের জন্য চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কম্পানির (সিসিসিসি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে অনেক আগেই। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এরই মধ্যে চীন অর্থায়ন করবে প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেবে। কিন্তু প্রকল্প শুরু করতে দেরি হওয়ায় এবং নির্মাণের মেয়াদকাল ২০২২ সাল নির্ধারণ হওয়ায় নির্মাণব্যয়ও বেড়ে যাবে।

নকশা অনুযায়ী দৈর্ঘ্য হবে তিন হাজার পাঁচ মিটার বা তিন কিলোমিটারের চেয়ে সামান্য বেশি। চট্টগ্রাম নগরীর নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে তলদেশে ঢুকে তা বেরোবে ওপারে কর্ণফুলি ফার্টিলাইজার কম্পানি (কাফকো) এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝামাঝি স্থান দিয়ে। মোট দুটি টিউব নির্মিত হবে। এর একটি দিয়ে গাড়ি শহরপ্রান্ত থেকে প্রবেশ করবে, আরেকটি টিউব দিয়ে ওপার থেকে শহরের দিকে আসবে। টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউবে বসানো হবে দুটি স্কেল। এর ওপর দিয়ে দুই লেনে গাড়ি চলাচল করবে। পাশে হবে একটি সার্ভিস টিউব। মাঝে ফাঁকা থাকবে ১১ মিটার। যেকোনো বড় যানবাহন দ্রুত স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবে এই টানেল দিয়ে।
টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে কর্ণফুলী নদীর ওপারে বিনিয়োগ শুরু করেছে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে নদীর ওপারে আংশিক চালু রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড। পাশাপাশি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। টানেল নির্মাণের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সরকার আনোয়ারায় একটি ইকোনমিক জোন স্থাপন করছে। পাশাপাশি চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ ‘চায়না ইকোনমিক জোন’ বাস্তবায়িত হচ্ছে।

টানেল নির্মাণ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। বর্তমানে এই রুটে চলাচলকারী গাড়িগুলো কর্ণফুলি সেতু ও কালুরঘাট সেতু দিয়ে চলাচল করছে। এতে প্রতি গাড়িকে গড়ে ২০ মিনিট বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। টানেল দিয়ে পার হলে এ সময়টুকু বাঁচবে। ঢাকা থেকে পণ্যবাহী গাড়ি সরাসরি কক্সবাজার যেতে সময় ও দূরত্ব দুটিই কমবে। যানজট ছাড়াই নিরবচ্ছিন্নভাবে পৌঁছতে পারবে গন্তব্যে। মহেশখালী থেকে একটি গাড়ি টানেল দিয়ে সরাসরি ঢাকায় পৌঁছতে পারবে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ না করেই। কর্ণফুলির ওপার থেকে একজন ব্যবসায়ী ১০ মিনিটেই চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছতে পারবেন। এই যে স্বপ্নের টানেল, যার সুবিধাগুলোও স্বপ্নের মতো। চট্টগ্রামের মানুষ যা আগে স্বপ্নেও ভাবেনি তা এখন বাস্তবে দেখতে পাবে। এই টানেলের কাজ সম্পন্ন হলে নদীর এপার এবং ওপারের দুইটি শহর এক সিটিতে পরিণত হতে পারে। সর্বোপরি সৃষ্টি হবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কর্মের সুযোগ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। চট্টগ্রামের মানুষকে একদিন যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ‘দ্যা রোল মডেল অব লিডারশিপ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে তার হাত ধরেই।

ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু রাজনীতিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট