চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বনাশা মাদকের আগ্রাসন রুখতেই হবে

মুহাম্মদ মুসা খান

১৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:০১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে মাদকের ব্যাপকতা ও মাদকবিরোধী অভিযানের কথা এখন আর গোপন কিছু নয়। বিগত কয়েক বছর যাবৎ মায়ানমার হতে চোরাপথে আসা ”ইয়াবা” নামক ভয়ানক এক মাদক পুরো দেশটাকে যেনো নাড়া দিচ্ছিলো। মাদক তথা ইয়াবার ব্যাপকতা বিবেচনা করেই সরকারের পক্ষ থেকে মে’১৮ হতে ”চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে”-শ্লোগান নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমনের মতই মাদক বা ইয়াবা সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। মূলতঃ এরপর হতে র‌্যাব-পুলিশ সার্বক্ষণিক মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমদও দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মাদক নির্মূলে তাঁর সদিচ্ছার কথা বলে আসছেন। র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদও মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা ব্যক্ত করেছেন।

মাদক মূলতঃ জীবন ধ্বংসকারী একটি ড্রাগ। এক শ্রেণীর মুনাফালোভী মানুষ নিজেদের লোভের কারণে সমগ্র মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই মাদকের ছোবল হতে মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য প্রায় প্রতিটি দেশেই মাদকবিরোধী কঠোর আইন হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাদকবিরোধী অভিযানে প্রতিবছর দেশে-বিদেশে ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে থাকে বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে। মাদকবিরোধী অভিযানের সংবাদ কম বেশী পৃথিবীর সব দেশে শোনা যায়। ল্যাটিন আমেরিকান দেশ কলম্বিয়া-মেক্সিকো হতে শুরু করে এশিয়ার ফিলিপাইন পর্যন্ত সব দেশেই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তো ২০১৬ সনে ক্ষমতা গ্রহণের পর হতে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ পর্যন্ত সেখানে মাদকবিরোধী অভিযানে ২০ হাজারের অধিক মাদকব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার এবং আত্মসমর্পণ করেছেন ১৩ লাখের অধিক। অনেকে ফিলিপাইনের এই চিত্রকে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মনে করলেও প্রেসিডেন্ট রডরিগো মনে করেন, মাদক নিয়ন্ত্রনের জন্য কোন বিকল্প নাই। আমাদের দেশে মাদকবিরোধী অভিযানে ইতোমধ্যে সারাদেশে বন্দুকযুদ্ধে প্রায় ৪’শ মাদকব্যবসায়ী নিহত হয়েছে এবং আত্মসমর্পণ করেছে শতাধিক। এর মধ্যে বেশী মারা গেছে কক্সবাজার জেলাতে।

স্মরণযোগ্য, একসময় মাদক বলতে গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ ইত্যাদিকে বুঝাতো। কিন্তু এখন মাদক বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ানমার হতে আগত ইয়াবা টেবলেট’কে বুঝায়। অনেকের অভিযোগ মায়ানমার সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে ইয়াবা টেবলেট উৎপন্ন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যাতে বাংলাদেশের যুবসমাজ মাদকের ছোবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এই অভিযোগ একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশ সরকারের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বিগত দেড় বছর যাবৎ ইয়াবাব্যবসায়ী তথা মাদকবিরোধী সাড়াশি অভিযান চালানোর পরও এবং ইয়াবা বা মাদকের ব্যাপারে জিরো টরালেন্স দেখানোর পরও ইয়াবার পাচার বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ইয়াবাসহব্যবসায়ী ধরা পড়ার সংবাদ আমরা দেখছি। মায়ানমার যদি অত্যন্ত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার না করতো, তাহলে এতদিনে ইয়াবাব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতো। আশ্চর্যের বিষয় যে, র‌্যাব-পুলিশ প্রতিদিন ইয়াবা উদ্ধারের পরও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করে ইয়াবা পাচার/ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে।

সম্প্রতি নারায়নগঞ্জ র‌্যাব-১১-এর ইয়াবা উদ্ধারের একটি ভিডিও চিত্র নিউজ টুয়েন্টি ফোর এবং র‌্যাব-১১-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চট্টগ্রামের সন্তান জসিম উদ্দিন-এর ফেসবুক পোস্টের বদৌলতে দেখার সুযোগ হয়েছে। এতে দেখা যায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একটি বিলাসবহুল এসি গাড়ির এক যাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দফায় গাড়িতে ইয়াবা’র কোন হদিস পায়নি র‌্যাব কর্মকর্তারা। কিন্তু বিশেষ কায়দায় একান্তভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পর সেই যাত্রী স্বীকার করেন যে, সে ইয়াবা নিয়ে কক্সবাজার হতে এসেছেন এবং ইয়াবাগুলো গাড়ির উপরের দিকে চুম্বক দ্বারা আটকে রেখেছেন। আর ইয়াবার গন্ধ যেন বুঝা না যায়, সেজন্য ইয়াবা পাচারকারি সাথে শুটকি নিয়ে এসেছেন। বাসযাত্রী সেই ইয়াবা পাচারকারীর দুর্ভাগ্য যে, র‌্যাবের এই চৌকষ কর্মকর্তা ও তাঁর টিমের ব্যক্তিক্রমী জিজ্ঞাসাবাদে এক পর্যায়ে স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ইয়াবাগুলো উদ্ধার হয়। শুধু ইয়াবা উদ্ধার করেই র‌্যাব-১১-এর এই কর্মকর্তা থেমে থাকেনি। ইয়াবা বিক্রির সাথে জড়িত পুরো চক্রকেই তাঁরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। অভিনন্দন র‌্যাব-১১-এর সবাইকে। র‌্যাব-১১-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন সব সময় ব্যতিক্রমী কিছু অভিযানের সংবাদ প্রচার করেন, যা দেশ ও জাতির পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজেও জলদস্যুদের উপদ্রব ও মাদক তথা ইয়াবার বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর পূর্বেও তিনি হুজুর টাইপের একজন মাদক পাচারকারিকে আটক করে পেটের ভিতর হতে ইয়াবা উদ্ধার করেছেন।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, এক শ্রেণীর মুনাফাখোর নিজেদের অর্থলোভে দেশের সর্বনাশ করার ব্যাপারে সামান্যও দুশ্চিন্তা করেন না। দেশের ক্ষতি মানে ১৬ কোটি মানুষের ক্ষতি। এই সাধারণ সত্যটুকু তাঁদের মনকে এতটুকু বিচলিত করে না। অভিনব কায়দায় গ্যাস চুরির বিষয়ও উদঘাটন করা হয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের সম্পদ চুরির সাথে মাদকব্যবসার কোন পার্থক্য নাই। মাদকব্যবসায়ীদের যেমন ক্রস ফায়ারে দেয়া হয়, তেমনি কোটি কোটি টাকার গ্যাস চুরি, বিদ্যুৎ চুরির সাথে জড়িতদেরও ক্রস ফায়ারে দেয়া উচিত।

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে মারার বিষয়ে প্রথম দিকে সবাই সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে কক্সবাজারে একজন কাউন্সিলর মারা যাওয়ার পর দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠে। কেউ কেউ ক্রসফায়ার বন্ধ করারও দাবী জানান। কিন্তু মাদকবিরোধী এমন সাঁড়াশি অভিযানের পরও মাদক তথা ইয়াবা ব্যবসার অভিনব পদ্ধতি দেখে আমাদের মনে হচ্ছে, বর্তমান সময়ের ইয়াবাবিরোধী অভিযান অব্যাহত তো রাখতে হবেই, বরং আরও জোরদার করতে হবে। সম্প্রতি কক্সবাজারে অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনে ঢাকার এক ধণাঢ্য ব্যবসায়ীর মেয়ে মারা গেছেন বলে আমরা পত্রিকান্তরে জেনেছি। মেয়েটির দুঃখজনক মৃত্যুর সংবাদে বুঝা যায় যে, ধণাঢ্য মানুষদের ছেলে-মেয়েরা ইয়াবা সেবনে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া উঠতি বয়সের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে মেয়েও ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে নিজ নিজ ছেলে-মেয়ের গতিবিধি আচার-আচরণ লক্ষ রাখা সব অভিভাবকদের উচিত। এক শ্রেণির পুলিশসদস্যও মাদক পাচারের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে। এধরণের প্রবণতা দেশের জন্য মংগলজনক নয়। যাঁরা আইন প্রয়োগ করবেন, তাঁদেরকে লোভ-লালসার উর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মানুষের আস্থার স্থান যেন নষ্ট না হয়।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীন দেশে অপরাধীদের অপতৎপরতা চলতে পারে না। পরিবেশ ধ্বংসকারী, ভূমিদস্যু, নদীখাদক, গ্যাসচোর, বিদ্যুৎচোর, খাদ্যে ভেজালকারি সব জনবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করতে হবে। এই দেশকে রক্ষা করতে হবে।

মুহাম্মদ মুসা খান কলামিষ্ট, সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট